Pages

Monday, June 11, 2012

অধরা ফাইনাল


আমার মা বলেন ছেলেদের সৌন্দর্য আচরনে আর কাজে। আমি অবশ্যই এই কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেই সব সময়।
দুপুরে খেলা দেখতে যাবো,এই উত্তেজনায় সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। মিষ্টি আর পরোটা দিয়ে জম্পেশ একটা খাওয়া দিলাম। পলাশি মোড়ের দোকানগুলো একটু ময়লা হলেও খাবার বানায় বেশ। পেট ডলতে ডলতে সবাইকে ফোন দিলাম। সবাই রেডি।

আমি সাবান ডলে গোসল করে,গায়ে ২-৩ টা স্প্রে ছিটায় নেমে পড়লাম রাস্তায়। শাহবাগ জাদুঘরের সামনে সবার সাথে দেখা। কেমন একটা চাপা উত্তেজনা সবার মধ্যে। আমাদের মধ্যে সব থেকে কৃপণ রাসেল দেখি চায়ের বিল দিতেছে। সে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য। সবাই বলল বাংলাদেশ আজকে জিতলেই ফাইনালে। কি নাকি মাথায় মাথায় টাকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ( হেড টু হেড) আমি ক্রিকেট একটু কম বোঝার চেষ্টা করি। এত হিসাব বুঝি না,কি সব রানরেট,বোনাস পয়েন্ট এই সব আর কি। আমি নিজে মেরে খেলতে খুব ভালবাসি।

ক্যাডেট কলেজে জরুরী এক ম্যাচে হিসামের এক ফুলটস বলে সামনে এসে ব্যাট চালাতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গিয়েছিলাম,তখন থেকেই মূলত আমার ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। যেহেতু আমি বাংলাদেশী অর্থাৎ যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষন আঁশ। আমি আম্পায়ারের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালাম। সোজা হেটে চলে গেলাম তার কাছে তাকে বোঝাতে থাকলাম কেন ফুলটস বলটি তার নো বল কল করা উচিত। কিন্তু তিনি আমায় তাবুর পথ দেখলেন। এছাড়াও বরিশালের গৌরনদী সরকারী কলেজ মাঠে নিজ শাখার ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নেমে প্রথম বলে শূন্য রানে আউট হওয়া আমার জলন্ত ক্যারিয়ারের আর একটি কলঙ্ক।

স্মৃতিচারণ করতে করতেই হিসাম চলে আসলো। দেখেই মেজাজ বিষিয়ে গেল। এসেই নিকোটিনের সরবরাহ করল। ওর উপর থেকে রাগ ঝেড়ে ফেললাম। আমার সবার কাছ থেকে আরও কিছু খাবার ইচ্ছে ছিল। এই যেমন চটপটি/ কলিজার সিঙ্গারা/ ঝালমুড়ি। কিন্তু সবাই খুব তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পরল সাথে আমিও। কি গাদাগাদি, বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। একহাতে আমি হ্যান্ডল ধরে আছে অন্য হাতে পেছনের পকেটের মানিব্যাগের অবস্থান নিশ্চিত করছি।
ভাড়া নিতে আসলে সবাই অর্ধেক ভাড়া দিল। এইটা নাকি ছাত্র ভাড়া। ছাত্র হয়ে ফুল ভাড়া দেয়া নাকি খুবই অসম্মান জনক। আমি ছাত্র সমাজের সম্মান বজায় রেখে অর্ধেক ভাড়া ধরিয়ে দিলাম। বাসের মধ্যে আমাদের মতো অনেক খেলা দেখা পাবলিক। এরাও যাচ্ছে। এক পাশে দেখলাম কিছু রমণীও বাংলাদেশের পতাকা গালে মুখে একে বসে আছে। ব্রন ঢাকার জন্য না দেশপ্রেম বুঝবার পারলাম না ঠিকমত। যাই হোক গুরু হিসাম সবসময় বলেন যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। আমি এক মেয়ের চোখে চোখ মিলাইয়া মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে লাগলাম। উহাও আমাকে দেখে বেশ মুচকি হাসি দিতে লাগলো। প্রথম পর্ব পাশ করা গিয়েছে ভেবে আমি দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তুতি নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম,অর্থাৎ কথা বলতে হবে,সজারুর মতো মাথার চুল উচু হইয়া আছে কিনা জানা দরকার,আমি হাত দিয়া চুল ঠিক করতে গেলাম,এই সময় বাস ব্রেক করল। আমি ভারসম্য হারিয়ে প্রায় উশটা খাবার জোগাড় করিলাম,পাশের বন্ধুর প্যান্ট বেল্ট ধরে পতন রোধ করলাম। আমার এমন অবস্থা দেখে সেই মেয়ে খিল খিল শব্দে হাসিয়া উঠল,আর পাশের মেয়েদের এই কাহিনী রস মাখিয়ে বলতে লাগলো।
আমি ভগ্ন হৃদয়ে উহার সাথে হালকা রোমাঞ্চের আশা ছাড়িয়া চুপ চাপ দাঁড়াইয়া রইলাম।

এক যুগ পর বাস আসিল মিরপুর। দরজার অপেক্ষা করতে পারলাম না, জানালা দিয়ে নেমে গেলাম। চোখের সামনে মুসলিম সুইটস এর বড় সাইনবোর্ড
- হিসাম শোন,তোর এক মামা না মুসলিম সুইটস এর মালিক?
- তো কি হইছে?
- না মানে খুব তৃষ্ণা পাইছে, একটা কোক খাওয়াবি?
- তুই বিদেশ গেছস ঠিক আছে,কিন্তু তোর আচরন এখনও বরিশালের মতই আছে।
আমি কোক পাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুই পাটি দাত বের করে একটা হাসি দিলাম হিসামের উদ্দেশে। উহাকে যদিও খুশি মনে হইল না। হিসাম আমাকে একটা হাফ লিটার কোক এনে দিল। আমি কোক খুলে গিলতে লাগলাম,আর ওকে বুঝাইতে লাগলাম কোক কত ক্ষতিকর,এবং কেন খাওয়া ঠিক নয়( ডাক্তারি দৃষ্টিকোন থেকে) বলতে বলতে আমার কোক সাবাড় হয়ে গেল,আমি ওকে বললাম
_ থ্যাংকস বাডি

ও মনে হয় মৃদু একটা গালি দিল,আমি গায়ে না মেখে ওর সাথে নিকোটিন শেয়ার করে দলের অন্যদের ধরার জন্য পা চালিয়ে হাটতে লাগলাম।
হায় হায় হায় বাংলাদেশে নাকি মানুষ ১৬ কোটি। আমার মনে হোল ২০ কোটি। এত মানুষ ক্রিকেট খেলা দেখে! ইশ হতাশ হয়ে ক্রিকেটটা না ছাড়লেই ভালো হত,মনে মনে নিজেকে খুব গালি দিয়ে নিলাম।

এত ভিড়। কিভাবে ঢোকা যায়। কোন উপায় নেই। মানব সমুদ্র। আমি হিসামকে বললাম সময় নষ্ট করে লাভ নাই,দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি চলুক,সরিষার তেল একটু বেশি হবে সেই সাথে ঝাল ও। হিসাম আমার দিকে তাকিয়ে আরও কিছু গালাগালি দিল। বরিশালের সব ছেলেই নাকি এমন,আমি গায়ে মাখলাম না কারণ বরিশালের সবাই কেমন তা দিয়ে আমার কাম নাই,আমি জানি আমি ভালো ছেলে। তাছাড়া কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। নিমিষেই ঝাল মুড়ি শেষ হয়ে গেল। আমি বললাম এভাবে দাড়িয়ে থাকার কোন মানে নাই লাইনে,দ্রুত ঢুকতে হবে ভেতরে। পরে নাহয় জায়গা পাওয়া যাবে না। ও জিজ্ঞাসা করল কিভাবে? আমি শারলক হোমস মার্কা হাসি দিয়ে বললাম চল। ঢুকে পড়লাম জনসমুদ্রে। ঠেলাঠেলি করতে লাগলাম সমানে,গেট থেকে তখন ও মিটার সাতেক দূরে। চোখ টিপলাম হিসামকে,এবং সেই সাথে সাথে বমি করার ভাব,বার বার হেচকি তুলতে লাগলাম,আর মুখ থেকে থুথু ফেলতে লাগলাম,লোকজন জামাকাপড় নষ্ট হবার ভয়ে সড়ে দাঁড়ালো,আমি বললাম শ্বাস নিতে পারছি না, আবার বমির ইমো,হিসাম আমাকে ধরে সামনে আগাতে থাকলো। সবার চোখে সহানুভূতি দেখতে পেলাম।

গেটের পুলিশ আমাকে আপত্তিকর ভাবে সার্চ করল,এখানে ওখানে পেষণ সহকারে,যাদের সুড়সুড়ি আছে তারা কিভাবে মাঠে ঢোকে বুঝতে পারলাম না আমি। ভেতরে প্রবেশ করে আমি বিজয়ের হাসি ঝাড়লাম হিসামের উদ্দেশে। হিসাম বলল আমি বিদেশে থাকি এরকম কোন ছাপ আমার মধ্যে নাই। আমি মুচকি হেসে বললাম “ ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে” তোর ইচ্ছে করলে তুই ফেরত গিয়ে আমার মুড়ি, মানে ঝাল মুড়ি খেতে পারিস,পরে লাইনে দাড়িয়ে ঢুকিস। প্রত্তিউত্তরে বেশ কিছু গালি ধেয়ে আসলো,এগুলো গায়ে মাখার কোন কারণ নেই,যখন প্রতিভার স্ফুরন ঘটে মানুষ তখন বিপক্ষে অবস্থান নিতে থাকে। এই যেমন বিজ্ঞানী ব্রুনো।

যাই হোক সিট পছন্দের বিষয়টা বন্ধুদের উপর ছেড়ে দিলাম,বহু মাতব্বরি করেছি আর না। খেলা ততক্ষনে শুরু হয়ে গিয়েছে। পকেট ডিনামাইট মুশফিক নাকি ফিলন্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিছে। বোকা ক্যাপ্টেন। কে যেন বলেছিলেন টসে জিতলে ব্যাট করো,দ্বিতীয়বার ভাবো তবুও ব্যাট করো,পিচ ভেজা থাকলেও ব্যাট করো। এই কথা সবাইকে বলতেই সবাই দেখলাম আমাকে গালি দিচ্ছে। যাই হোক খেলা দেখতে থাকলাম। বোরিং খুব বোরিং,যতক্ষণ দিলাশান আছে ক্রিজে ততক্ষন চুপচাপ বসে থাকাই ভালো। দিলশান সেই রকম সব মাইর মারতে লাগলো অফ সাইড দিয়ে,দিলশানের মাঝে আমি আমার নিজের শৈশবের শট খেলার ছাপ দেখতে পেলাম স্পষ্ট। সেই সাথে আগে ব্যাট করা কেন দরকার সবাইকে বুঝতে লাগলাম। দিলাশান একের পর এক শট খেলে আর আমার বিরক্ত লাগে। আমি মাথায় সানগ্লাস উঠায় এক জোড়া সুন্দর চোখ খুজতে থাকি। সহসা জয়াবর্ধনে বোল্ড হয়ে গেল। যাক একটা পিলার পড়ছে,রইল বাকি দুই আমি আশা ফিরে পেলাম।

বাহাতি সাঙ্গাকারা আসলো। সাঙ্গাকারার বউএর সাথে একবার হোটেল শেরাটনে আমার দেখা হইছিল। খুব সুন্দরী আর অমায়িক ভদ্র মহিলা। আমাকে মনে হয় একটা অটোগ্রাফ ও দিছিলেন,কই যেন হারায় ফেলছি, উফ আমারে দিয়ে কিছুই হোল না, আউট,আউট আউট। সাঙ্গাকারার বিলাসী কাভার ড্রাইভ নাজিমউদ্দিনের তালুবন্দি। আমি এবার চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গেলাম। নড়ে চড়ে বসা দরকার। ম্যাচ সমানভাবে বিষাক্ত এখন। যে কারো দিকে পেন্ডুলাম ঝুলে পড়তে পারে।
আমি সবাইকে বললাম যেহেতু আকাশে মেঘ আছে বাংলাদেশ পরে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভালো করেছে। দেখে শুনে খেলা যাবে। সবাই আমার দিকে চোখ কুচকে তাকাল।
কিছুক্ষন পর দেখি আবার নাযমুল বেটা। হায় হায় দিলশান বোল্ড। আমার মতো কাট শট খেলতে গিয়ে বোল্ড। এবারে আমি গেঞ্জি খুলে নাচতে লাগলাম। বন্ধু বান্ধব আমাকে টেনে ধরে বসিয়ে গেঞ্জি পরতে বলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? সবাই বলল আশে পাশের সবাই নাকি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। হুম বুঝতে পারলাম বিদেশে গিয়ে আমার রঙ ভালই ফর্সা হয়েছে।

উফ এর পর কি বোরিং। জীবনে কোনদিন কাপুগেড্রারে ভালো খেলতে দেখি নাই, ১২, ১৩ বরজোড় ৩০ এর ঘরে। সে দেখি হাটু গাইড়া বইসা সুইপ পিটায়। মেজাজ চরমে উঠল। সেটা আবার রাজ্জাক ভাইয়ের বলে। রাজ্জাক ভাই আমার প্রিয় খেলোয়াড় সবচে। এমন গালি দিলাম কাপুগেদ্রারে,সে শুনলে নিশ্চিত খেলা ছেড়ে দিত।
যখন কেউ বোর হয় তখন তার আইসক্রিম কেন খাওয়া প্রয়োজন,এইটা বিশ্লেষণ করতে বসলাম হিসামকে। মানসিক চাপ মুক্তিতে আইসক্রিম কেমন বড় একটা ভূমিকা রাখতে পারে এই দিয়ে শুরু করলাম। হিসাম সরাসরি আইসক্রিম অলাকে ডেকে আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দিল। সবুজ কালারের আইসক্রিম ভিতরে লেবুর গন্ধ। আমি আইসক্রিম খাওয়াতে মন দিলাম। খাবার পরে প্যাকেট কই ফেলব তাই নিয়ে বিপদে পড়লাম। দেশের বাইরে সব জায়গায় ডাস্টবিন থাকে এখানে নেই কেন,এই নিয়ে সরকার,আমাদের সমাজ ব্যবস্থা,সংস্কৃতি এর উপর চরম বিষেদাগার ঝেড়ে দিলাম। কেউ একজন বলে উঠল
“ পুরান পাগলের ভাত নাই,নতুন পাগলের আমদানি”
আইসক্রিমের প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে গুজে রাখলাম। রাখতে রাখতেই
বাপরে বাপ
মুশফিকের কি লাক!
আউট হয়ে গেল সেট ব্যাটসম্যান। তারপর মড়ক লাগলো,স্প্রে মারলে যেমন একটা একটা তেলাপোকা টপটপ করে পরে,ব্যাটসম্যানরাও তেমন পরতে লাগলো। রাজ্জাক ভাইয়ের লাইন লেংথ দেখে পুরানো রেস্পেক্ট ফিরে আসলো আবার। সেই সাথে এই শাকিব ছেলেটা। খুব বুদ্ধিমান প্লেয়ার। নিজের একটা ছাপ দেখতে পেলাম এই দুজনের মধ্যে।

গড়াতে গড়াতে সিংহরা কিভাবে কিভাবে ২৩২ রান করে ফেলল। আমি বললাম হায় হায় এখন কি হবে। বাংলাদেশের সব ব্যাটসম্যান ভালো খেলে ফেলছে অলরেডি। সাকিব,তামিম,নাসির,মুশফিক সবাই। কারো কাছ থেকেই তো কিছু পাওনা নাই। সবাই বলল ধুর,ম্যাচ জিতবো।

এর মধ্যে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি নিয়ে রবি ঠাকুরের কি একটা গান মনে করতে করতে শেষ পর্যন্ত মনে আসলো না। ধুর একটা মানুষ এত গান এত কবিতা লিখলে কি মনে থাকে নাকি কিছু।
বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য সিট ছেড়ে ছাউনি এর নীচে চলে গেলাম। সেখানে এত মানুষ,সবাই জামা কাপড় বাচাতে সেখানে জমা হয়েছে।
শাদা জামা আর নীল জিনস পরা একটা মেয়ে দেখলাম গা বাচাতে চেষ্টা করছে বৃষ্টি থেকে। আমি একটু সরে জায়গা করে দিলাম। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল থ্যাংকস।
বৃষ্টিভেজা চুল,কপাল চুইয়ে টপটপ করে জল পড়ছে,হাতে ব্যাগ আর টিস্যু,সেই টিস্যু দিয়ে জল মোছার চেষ্টা করছে,টিস্যু ভিজে ছিড়ে ছিড়ে ওর মুখে লাগে থাকতে লাগলো।
আমি বললাম আপনি স্বাগতম।
_ আপনার সারা মুখে টিস্যু লেগে আছে।
- ও আচ্ছা। দেখছি।

ও সারা মুখ ঘষতে থাকলো,টিস্যুর একটা টুকরো গিয়ে ঢুকল চোখে। আমি আরও ১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম,এখন শুরু হয়েছে চোখ ঘষা। পাশের বান্ধবী দেখি চোখের পাতা খুলে আঙ্গুলে বের করে আনতে চাইছে টিস্যু।
এখন একটু ডাক্তারি না ফলালেই নয়। বললাম থামুন,কি করছেন,চোখ খুয়াবেন।
দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বললাম আপনি চোখ বন্ধ করুণ,এখন এক আঙ্গুল দিয়ে করে মাসাজ করুণ,আস্তে করে নাকের পাশে নিয়ে আসুন মাসাজ করে,যখন অনুভব করবেন টিস্যু নাকের পাশে চলে এসেছে,চোখ খুলবেন। সেকেন্ড ১৫ পর দেখলাম,চোখ খুলল সে,আস্তে করে নাকের পাশ থেকে টিস্যু সরাল তারপর। ততক্ষনে তার চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। পানিও বের হচ্ছে একটু একটু।
- আপনাকে থ্যাংকস।
- আপনি আবারো স্বাগতম। এভাবে একজনের চোখে আর একজনের খোঁচাখুচি করা ঠিক না। এটা নাটক সিনেমায় দেখার জন্য উপাদেয় রোম্যান্টিক সিন,বাস্তবে না ঘটলেই ভালো।
- আপনি ডাক্তার নাকি?
- না।
এই অংশটা খুব নার্ভাস। আমার খুব ভালো লেগেছে ওকে,এখন কিভাবে বলি,কিভাবে আরও একটু কথা বলা যেতে পারে।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। সবাই আস্তে আস্তে নিজেদের সিটের দিকে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম সেও চলে যাবে।
- কোথায় বসছেন?
- ওই তো ওই কোনে
- আপনারা দু জন?
- জী
- আমাদের সাথে চলে আসুন,একসাথে বসে ব্যাটিং দেখা যাবে।
ও একটু ইতস্তত করতে লাগলো,ওর বান্ধবিকেও বললাম,সে দেখলাম মহা উৎসাহী। চলে এলাম আমি সদলবলে। সবাই দেখলাম কেমন একটু আড়চোখে তাকায় আমার দিকে। বসে বসে আরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা,একটা পেপার কিনে পড়তে লাগলাম। নিজে নিলাম সম্পাদকীয় পাতা,বাকি সবাইকে ভাগ বাটোয়ারা করে দিলাম খেলা,বিনোদন, শেষ পাতা ইত্যাদি।
সম্পাদকীয় পাতা পড়লে একটা ভাব আসে। যে ভাবটা অন্য পাতা পড়াতে নেই।
এর মধ্যে ওর সাথেও টুকটাঁক গল্প করতে লাগলাম,ওর বান্ধবীটা বেশ বাচাল,আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করে। কই থাকি,কি করি।এই রাতেও আমার মাথায় সানগ্লাস কেন ইত্যাদি। যার সাথে কথা বলতে চাই,সে তখন চুপ চাপ বসে আছে আর একটু একটু কাপছে। বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস নেই বোধহয়।

শুরু হোল ব্যাটিং। হায় নাজিমের সেই বিলাসী শট,বোল্ড। ব্যাপার না,সবাইকে সান্ত্বনা দিলাম,জহুরুল ঝানু খেলোয়াড়, ৮ বছর ঘরোয়া লীগ খেলছে। ঝাঁকড়া চুলের মালিঙ্গা সমানে বাউঞ্চার দিয়ে ছেলেটাকে কাপায় দিতেছে। খুব খারাপ লাগলো। কোন মতে জহুরুল ঠেকায় দিল ওভারটা। পরের ওভারে ওরে বাপ,সমস্ত শক্তি দিয়ে জহুরুল পুল করতে গেল,আমি মনে করলাম ৬ না হলেও ৪ তো হবে,দেখি সার্কেলের মধ্যে ক্যাচ।
সবাইকে বুঝিয়ে বললাম যে ফুটওয়ার্কে ঝামেলা আছে, ফ্রন্ট ফুটে এই শট সবাই খেলতে পারে না,এবং আমি কলেজ জীবনে এই শট খুব ভালো খেলতাম।
এবারে কেউ কিছু বলল না,মনে হোল দু জন মেয়ে আমাকে কিছু গালি হজম করা থেকে বাচিয়ে দিল।
মুশফিকের জুয়া মুশফিক হারল। ৪ নাম্বারে একটা ভালো ব্যাটসম্যান এর অভাব বোধ করলাম খুব। মুশফিকের বোল্ডের পর হিসামকে বললাম তোর কি মনে আছে ৪ নাম্বারে আমি কলেজে কিভাবে ধরে ধরে ব্যাট করতাম? হিসাম দাতে দাত খিচে বলল আছে। মনে আছে।
এই দিকে সেই মেয়ের মোবাইল বাজে,আমি ভেবে নিলাম ছেলেবন্ধু। মনটাই ভেঙে গেল। পরে দেখি না, বাসা থেকে। ফোন ধরল সে,কি কি বুঝাবার চেষ্টা করল তার মাকে। ও পাশ থেকে শুধু চিৎকারই শুনলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে, আমাকে সে বলল বাসা থেকে চিল্লানি দিচ্ছে, এত রাত,এবং বৃষ্টি। দুয়ে মিলে যা দাঁড়ালো সেটা হোল তাকে এখনি বাসায় ফিরতে হবে।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ধুরমুর করে উঠে দাঁড়ালো দুই বান্ধবী। আমি ওকে বললাম নাম্বারটা রেখে যান,আমি মেসেজ দিয়ে খেলার খবর দেব।
ও বেশ কিছুক্ষন চিন্তা করে আমাকে নাম্বারটা দিয়ে গেল। যাবার সময় আর একবার হাত নেড়ে বাই বলে চলে গেল।
মেয়েদের প্রতি অভিবাবকদের আরও অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন,এবং তাদের আরও অনেক বেশি স্বাধীনতা দেয়া উচিত, এই জাতীয় একটা লেকচার ঝাড়তে শুরু করলাম,কিন্তু সবার সিরিয়াস মুড দেখে অফ গেলাম।
হায় হায় মেয়েটার নামই জানা হোল না। একটা মেসেজ ঝেড়ে দিলাম “ আপনার নাম কি জানতে পারি?”
উত্তর এল “অধরা”।

খেলা জমে উঠছে তখন চরম ভাবে। দল থেকে প্রায় বাদ পরা তামিম উইকেটের চার দিকে শট খেলতেছে। তার মধ্যে আবার নাকি তার জন্মদিন আজকে। একদম ঘিয়ের মধ্যে আগুন। ওপর পাশে শাকিব মারে খালি ক্লাসিক শট।
দুই জনের ৫০ হয়ে গেল। তামিম আরও একটা ৪ মারল। একটু তারপর আউট।
সবাইকে আমি বুঝিয়ে বললাম যে এটা টেকনিক না টেম্পারমেন্টের অভাব। ৫০ গুলোকে ১০০ করা খুব জরুরী।
মাঝে মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম খেলার খবর। ধন্যবাদ জানালো আমাকে অধরা। এরপর সাকিবরে আউট দিয়ে দিলেন আম্পায়ার। বুঝতে পারলাম না কতটা ক্লোজ।
শেষ ভরসা নাসির- রিয়াদ। এই জুটি বেশ দেখে শুনে খেলে দিল। ম্যাচ বের করতে তখন মাত্র ৩২ রান দরকার। মেসেজ পেলাম অধরা বাসায় পৌঁছেছে।
এরপর আর কি বলব উৎসব আর উৎসব,একটা ৪ মেরে ম্যাচ জেতালো নাসির। চিৎকার আর চিৎকার। বাংলাদেশ ফাইনালে। ভারত বাদ। পাকিস্তান বাংলাদেশ ফাইনাল।
সমস্ত মাঠে এক চিৎকার জয় বাংলা,জয় বাংলা,জয় বাংলা।

মাঠের চার দিকে ভিক্টরি ল্যাপ দিল বাংলাদেশ দল। সবাইকেই দেখলাম,রাজ্জাক ভাই খুব স্ল দৌড়ায়,বল ভালো করে কিন্তু ফিল্ডিঙে উন্নতি করা দরকার রাজ্জাক ভাইয়ের। এমন কথা বলতেই বেশ কিছু গালি হজম করলাম।
সব কিছু দেখা শেষ করে হিসামের সাথে নিকোটিন শেয়ার করতে করতে বললাম,এশিয়ার সেরা বোলিং তো বাংলাদেশের। শুধু শাহাদাতটা কেমন মাইর খায়।
এই সব হিবিজিবি করতে করতে ফোন করলাম অধরাকে।
- কি খবর
- এই তো,ভাত খেলাম মাত্র। আপনারা কোথায়?
- জয় নিয়ে বের হলাম মাত্র। আপনিতো দেখতে পারলেন না খেলা।
_ হুম খুব খারাপ লাগছে, মা খুব টেনশন করছিল
- তো সমস্যা কি ফাইনাল দেখবেন
- আমার কাছে টিকেট নেই তো।
- আমি আপনার জন্য একটা টিকেট নিয়ে রাখবো,আসবেন আপনি?
অনেকক্ষন নীরবতার পর সে বলল আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। এখন রাখি পরে কথা হবে। আমি নিজেও একটা ঘোরের মধ্যে কথাগুলো বলে ফেলেছি। এখন খুব লজ্জা লাগছে। আর ওর লজ্জা পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
এত ভালো লাগছিল,অনেক হালকা মনে হচ্ছিল নিজেকে,আমার গেঞ্জি তখনও শুকায়নি, বাতাসে খুব ঠাণ্ডা লাগছিল। আরও একটা গান মনে করার চেষ্টা করলাম মনে মনে এবারে ঠিক মনে মনে পরল
“ তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম…………।।“

হিসামকে বললাম চল তোকে নান আর কাবাব খাওয়াবো। ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আমি গ্রাহ্য না করে মিরপুর ১০ নাম্বারের দিকে হাটতে লাগলাম।

কাল একটা দিন,তারপর ফাইনাল। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের। আর আমার সেমিফাইনাল। অধরার সাথে আরও একবার দেখা হবে।

0 comments:

Post a Comment