Pages

Monday, June 11, 2012

দেশ পুড়বে শুকনো তামাক পাতার মতো


সমস্ত বাংলাদেশ যখন বিপিএল জ্বরে আক্রান্ত,বলা ভালো গেইল ঝড়ে। দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়াল জামাত-শিবির। শুরু হয়েছিল গতকাল থেকেই। চট্রগ্রামের হাটহাজারীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরু । আজ আরও কয়েকটি মন্দিরে হামলা চালিয়েছে জামাত শিবির। নন্দিরহাটে লোকনাথ বাবার মন্দির ভাংচুর হোল আজ। বাবা লোকনাথের আশ্রম জ্বালিয়ে দিয়েছে। হামলা চালাচ্ছে হিন্দু বাড়িতে। জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি ঘর। নারীদের উপর নির্যাতন হচ্ছে। পুরুষদের উপর আক্রমণ চলছে। জনমনে আতঙ্ক,গাড়ি চলাচল বন্ধ।

এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়বে, সাধারন মানুষের ধর্মীয় আবেগকে পুজি করে জামাত-শিবির কতদূর যেতে পারে সেটা দেখার বিষয়। তথাকথিত খুনের বদলা নিতে জামাত- শিবির এই দাঙ্গা চালাবে,আর সাধারন মানুষকে বোঝাবে ইসলামি আন্দোলন এবং ইসলামি শাসন কায়েম,মূর্তি পুজা উচ্ছেদিকরন।

যতদূর মনে পরে সমগ্র বাংলাদেশে শুধুমাত্র চট্টগ্রামের ২টি আসনে জামাত সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছিল,২০০৮ সালে। সেই সমর্থন থেকেই সম্ভবত চট্টগ্রামকে লক্ষ্য করা,সেই সাথে খুনের! বদলা।

হাজারো সমস্যা জর্জরিত আমাদের এই ছোট্ট দেশ। এখানে এখন যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়,একটা শুকনো তামাক পাতার মত এই ছোট দেশটি নিমিষেই পুরে ছারখার হয়ে যাবে।

এরপর শুক্রবার সকাল থেকে হাটহাজারীতে সড়ক অবরোধ করে স্থানীয় মুসল্লিরা। হাটহাজারী থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার আগে (চট্টগ্রামের দিকে) দুপুরে সড়কের ওপর জুমার নামাজও পড়া হয়।

স্থানীয় অনেকেই বলছেন, জামায়াতে ইসলামী এই ঘটনায় ইন্ধন দিচ্ছে।

এই বিষয়ে হিন্দু স¤প্রদায়ের কেউই মুখ খুলছে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধি শুক্রবার নন্দীরহাট ঘুরে তিনটি মন্দিরে ভাংচুরের চিহ্ন দেখেছেন। এগুলো হলো- শ্রী শ্রী মগদেশ্বরী মায়ের মন্দির, জগন্নাথ বিগ্রহ মন্দির ও লোকনাথ মন্দির। এর মধ্যে মগদেশ্বরী মন্দিরে আগুনও দেওয়া হয়।

এছাড়া হাটহাজারী উপজেলা সদরে কালীবাড়ি মন্দিরেও ভাংচুরের চিহ্ন দেখা গেছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমীন হাটহাজারীতে রয়েছেন, স্থানীয়দের শান্ত করার চেষ্টা করছেন তিনি। তিনি দুপুরে পর নন্দীরহাট যান। সেখান থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে হেঁটে হাটহাজারী উপজেলা সদরে যান তিনি।

জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হাটহাজারীতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।

১৪৪ ধারা জারির ফলে কোথায় বেশি মানুষ জড়ো হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

মন্দির ভাংচুরের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে অস্থির করতে স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এম এ সালাম।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর জামায়াত-শিবির পরিস্থিতি অস্থির করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে।”

হাটহাজারীর নন্দীরহাট থেকে তিন কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে দুই ছাত্র নিহত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়।

বৃহস্পতিবারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওই এলাকায় যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি বলে মনে করেন সালাম।

হাটহাজারী থানা বিএনপির সভাপতি এস এম ফজলুল হক পরিস্থিতির অবনতির জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশাসন শুরু থেকে তৎপরত থাকলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না।”

এলাকায় স¤প্রীতি রক্ষায় বিএনপির সব নেতা-কর্মীদের কাজ করতে বলা হয়েছে জানিয়ে ফজলুল বলেন, এখন সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে হাজার খানেক লোক হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে। এতে নন্দীর হাট থেকে হাটহাজারী সদর পর্যন্ত সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে।

অবরোধকারীদের দাবি, বৃহস্পতিবার লোকনাথ সেবা আশ্রমের মিছিল থেকে মসজিদে ঢিল ছোড়া হয়েছিল। এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

সকালে পরিস্থিতি শান্ত করতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নন্দীর হাট গিয়েছিলেন। কিন্তু বিফল হয়ে ফেরেন তিনি।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে নন্দীর হাট এলাকায় লোকনাথ সেবাশ্রমের মন্দিরে হামলা হয়।

ওই মন্দির প্রাঙ্গণে শুক্রবার সকাল থেকে বার্ষিক মহোৎসব হওয়ার কথা ছিল। ভাংচুরের কারণে ওই উৎসব আর হচ্ছে না। মন্দির প্রাঙ্গণে বিপুল সংখ্যক র‌্যাব ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

এই ঘটনার শুরু বৃহস্পতিবার সকালে। স্থানীয়রা জানায়, লোকনাথ সেবাশ্রমের মহোৎসবের একটি শোভাযাত্রা স্থানীয় একটি মসজিদ অতিক্রমের সময় দুই পক্ষের কথাকাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর মন্দিরে হামলা হয়।

এই অংশটুকু বিডি নিউজ থেকে তুলে দিলাম। ১৪৪ ধারা ও দাঙ্গা সম্পর্কে একমাত্র এখানেই শেষ আপডেট পাওয়া গেল।
এবারে একটু ব্যাবচ্ছেদ করা প্রয়োজন, বলা হয়েছে সাধারন মুসুল্লি মানুষ আটক করছে, অবরোধ করেছে, যদি তাই হয়, তাহলে সারা বাংলাদেশের মুসুল্লিরা ঘুমাচ্ছে কেন? শুধু চট্টগ্রামের মুসুল্লিরা কেন খেপল?

এবারে সোজা চোখে দেখা যাক, শিবির কর্মীর খুনের জোর ধরে তারা এই তাণ্ডব চালাচ্ছে। যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে দেখলে কিছু কারন খুজে পাওয়া যাবে এই দাঙ্গার পেছনে
১) শিবির কর্মীর খুনের বদলা/ রক্তের বদলে রক্ত
২) বর্তমান সরকার এবং শাসনতন্ত্র কে নাড়িয়ে দেয়া।
৩) যুদ্ধাপরাধী বিচার থেকে সাধারন জনগন ও সরকারের দৃষ্টিচ্যুতি
৪) পরাশক্তি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা।
খুব সাধারন ভাবে এগুলো আমাদের চোখে পরে। কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো আমাদের চোখে পরে না,যেমন এই সব দাঙ্গার মাধ্যমে দলীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করা,ইস্যু তৈরি করে বিভিন্ন ইসলামি গ্রুপ থেকে চাদা সংগ্রহ। এবং ইসলামি রাষ্ট্র গুলোর কাছ থেকে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের সমর্থন আদায় করা।
কিন্তু কথা হোল সাধারন মানুষ যদি এই দাঙ্গায় অংশগ্রহন করে থাকে,কেন করল? কি এমন বলা হচ্ছে,হয়েছিল যার কারনে সাধারন মানুষ দাঙ্গায় অংশ নিয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা আসলে খুব আবেগ প্রবন,খুব অল্পতে আমাদের আমার মেকি আবেগ,অনর্থক আবেগ চাড়া দিয়ে ওঠে। এই যেমন, সারা সপ্তাহ নামাজ না পরে জুমার দিন মসজিদে হুমড়ি খেয়ে পরা, মসজিদের উন্নয়ন,মুসলিম ভাইদের উপরে অত্যাচার এই সব লেকচার শুনে মাথা দোলাই। আবার নামাজ থেকে বের হয়ে সব ভুলে যাই। শবে কদরের নামাজ না পড়লেও আমাদের হালুয়া,সন্দেশ রুটি খাওয়া চাই।
মূল কথা হোল মৌলিক কিম্বা মুখ্য বিষয়গুলো ছেড়ে আমরা গৌণ বিষয় নিয়ে খুব মাথা ঘামাই।

দাঙ্গায় যদি সাধারন মানুষ এসে থাকে তবে সেখানে জামাত-শিবিরের কিছু প্রোপাগান্ডা অবশ্যই ছিল। এবং আমি প্রায় নিশ্চিত সেই প্রোপাগান্ডাগুলো হল এমন-
১) সরকার ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে।
২) ভারত হিন্দুদের দেশ,হিন্দুরা ভারতের সাপোর্টে আমদের দেশে বেবসা-বাণিজ্য করছে,এবং লাভের টাকা দিয়ে ভারতে বাড়ি-জমি কিনছে।
৩) ভারতীয় পণ্য উচ্ছেদ করতে হলে হিন্দুদের সবার প্রথম উচ্ছেদ করতে হবে।
৪) মূর্তি পুজা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরা মূর্তি পুজা করে, পবিত্র ভুমি চট্টগ্রামকে দূষিত করছে।
এছাড়াও সীমান্তে বিসিএফ এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড আমাদের ভারত বিদ্বেষ তুঙ্গে তুলেছে। জামাত এই ইসুকে বুকে তুলে নিয়েছে, বহু হোক্স ছবি বিসিএফ এর নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে, মিথ্যাচার,ভুল তথ্য দিয়ে এইসব ছবি, আপডেট সাজানো হয়েছিল। সেই সাথে আমাদের কালচারের উপর ভারতীয় কালচারের প্রভাব এবং স্যাটেলাইট জগতে ভারতীয় চ্যানেলের ছড়াছড়ি।

সব বুঝলাম,তবে তার মানে এই না যে ভারত বর্জন ইস্যুতে আমাদের হিন্দু বর্জন করতে হবে। যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করেছেন,তারাও বাংলাদেশের নাগরিক। তাদেরও মাতৃভূমি বাংলাদেশ। হিন্দু ধর্মের কিছু পবিত্রস্থান রয়েছে ভারতে,এই যেমন গঙ্গা-কাশি। উদাহারন আছে আরও অনেক। উপাসনা-ইবাদত নিয়ে তর্ক চলেনা। সেই তর্ক উঠলে প্রথমেই বলতে হবে মুসলমানরা কেন মক্কা-মদিনা যাবে?
এই হিন্দুরা আমাদের দেশে যুগে যুগে নির্যাতিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, জ্বালানো হয়েছে। দিন বদল হয়নি,হাত বদল হয়েছে। ৭১ এ পুড়েছে সাইদি,নিযামি,আজমের হাতে। ধর্ষিত হয়েছে এদের শিস্নতলে। আর এখন এদের চামচাদের কাছে।

মধ্যরাতের শ্বেতপরী


সেদিন রবিবার ছিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এক বড় ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত ছিল। তার নিজের কোল্ড স্টোরেজ আছে, টমেটো দিয়ে দেশি মাছ, সালাদ আর খাশি ভুনা ছিল মেন্যু। আবার খেলাম হাতে মাখিয়ে। বিদেশ বিভুয়ে হাত দিয়ে খাবার সুযোগ পাওয়া যায় খুব কম। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিদায় নিলাম, একটা হিসাব মনে কষে রেখছিলাম,মেট্রো স্টেশনে পৌছাতে ১০ মিনিট, ট্রেনের জন্য ৫ মিনিট আর ইমারজেঞ্ছি আরও ১৫ মিনিট। সব মিলিয়ে শেষ ট্রেন আমার মিস করার কথা না। মেট্রো আবার রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায়।

রাস্তায় নেমে আমি হেলে দুলে হাটতে লাগলাম,বেশ ঠাণ্ডা দেখে মাথায় টুপি আর ওভার কোটের বোতাম সাঁটলাম। রবি ঠাকুরের তুমি রবে নিরবে গানের প্রথম কয়েকটা কলি সমানে ভাজতে লাগলাম। ট্রেন এ উঠে অগাথা ক্রিস্টির একটা বই খুলে বসলাম। আমার প্রথম জীবনের প্রেম এই অগাথা।মিনিট সাতেক পর আমার স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে আমার হোস্টেল ১২ মিনিটের হাটা পথ। বিদেশের বোকা গুলোকে রিক্সা কনসেপ্টটা শরবত করে গুলে খাইয়ে দেয়া উচিত। ট্রেন থেকে নেমে আমি এস্কালেটরে উঠলাম। পাতাল থেকে উপরে উঠতে এই বৈদুতিক সিঁড়ির আয়োজন। যখন উঠছি তখন আমার কয়েকধাপ উপরে একটা মেয়েকে দাঁড়ানো দেখলাম। উস্ক খুস্ক চুল আমার প্রথমে চোখে পড়ল। এক হাতে রেলিং ধরে হেলে আছে ,একটু লক্ষ্য করতেই দেখলাম পা কাপছে ওর। সিঁড়ি যখন চলন্ত এই পা কাপা খুব ভয়ঙ্কর। আমি কয়েকটা সিঁড়ি পেড়িয়ে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মৃদু কান্নার শব্দ পেলাম।এবং ঠিক সেই মুহূর্তে ওকে বড্ড ঠুনকো মনে হল,আমি পেছন থেকে ওর পিঠে হাত ঠেকালাম।এবং প্রায় সাথে সাথেই ও ওর শরীরের ভর আমার হাতের উপর ছেড়ে দিল। আমি দুই হাতে ওর কাধ ধরে ওকে ঠেকিয়ে রাখলাম। ও আস্তে করে বলল “স্পাসিবা” যার অর্থ ধন্যবাদ। মেট্রো স্টেশনে সর্বক্ষণ পুলিশ প্রহরা থাকে, আমি তাকে পুলিশের কাছে যেতে বললাম।
ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেল এবং সে আমাকে বলল কারো কাছে যাবার মত মানসিক অবস্থা তার নেই। এই কথা বলার সময় সে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল,আমি প্রচণ্ড এলকোহলের গন্ধ পেলাম,দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে আমার দেরি হল না। বুঝলাম প্রচণ্ড বিপদে আছে সে,এই মধ্যরাতে মাতাল অবস্থায় কাউকে পেলে পুলিশ খুব জ্বালাতন করে। তিলকে তাল বানিয়ে লিখিত অভিযোগ পত্রে সাক্ষর করতে বাধ্য করে, দীর্ঘক্ষণ স্টেশনে জেরা করে ইত্যাদি। একজন মানুষ হিসেবে ওকে এই মধ্যরাতে আমার সেখানে ফেলতে ইচ্ছে হল না। ততক্ষণে আমরা উপরে চলে এসেছি,পুলিশও দেখতে পেলাম, ওকে হাতে ধরে আমি এক্সিট এর দিকে হাটতে থাকি। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। ভালয় ভালয় আমরা বাইরে বের হয়ে আসলাম। বের হবার সাথে সাথে ওর বমি শুরু হল। আমি টিস্যু বের করে দিলাম।ও উদ্ভ্রান্তের মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আর কাদতে লাগলো।
- তুমি কোথায় থাকো?
-জানি না
- আমাকে ঠিকানা বল, আমি ট্যাক্সি ডেকে দেই।
- আমি জানি না, আমি বমি করার জন্য ট্রেন ছেড়েছি।
- তোমার কি নাম?
- আমার নাম লারিসা
- এখন কি করবে?
- আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ,তুমি যেতে পারো
- সাবধানে বাড়ি ফিরতে পারবে?
- সেটা আমি বুঝবো।
এর পর আর কথা থাকতে পারে না। আমি উলটা ঘুরে হাটা শুরু করলাম। একটু যেতেই আমাকে সে গলা উচু করে ডাকল।
- কি?
- আমাকে এক বোতল পানি কিনে দিতে পারবে? আমি এখানের দোকান চিনি না।
- দোকান এখান থেকে বেশ দূরে, হাটতে হবে,পারবে? ও মাথা ঝাকালো।
আমরা হাটতে লাগলাম ,জানুয়ারি মাসের উত্তাল হাওয়া, সেই সাথে তুষারপাত। ওর খোলা চুলে তুষার আটকে যেতে লাগল,পরক্ষনে বাতাসের ঝাপে সেই তুষার আবার উড়ে যেতে লাগলো। ওর সাথে একটা স্কুল ব্যাগ,আমি আমাকে দিতে বললাম, কারন ওর এখন হালকা হওয়া দরকার,সেই সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নেয়া প্রয়োজন।
আমি ওকে বাইরে দাড়াতে বলে দোকানের ভেতরে ঢুকলাম, ঝটপট একটা পানির বোতল আর এক ছোট বোতল লবন কিনে বেড়িয়ে আসলাম। এসে দেখি দোকানের পাশে ও বসে পড়েছে, চোখ বন্ধ, ওর শাদা জ্যাকেট তুষারে আরও শ্বেত হয়েছে। রোম্যান্টিক কিছু ভাবার মত মানসিকতা ছিল না, তবু একটা উপমা মনে এসেছিলা, শ্বেতপরী। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম, চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ি, তাই জানি ওর এ অবস্থায় অনেক বেশি রিলাক্স করা দরকার,সেই সাথে জ্যাকেট খুলে দিতে পারলে ওর আরও অনেক বেশি ভালো লাগতো।কিন্তু সম্ভব নয়,প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া কিম্বা ব্রঙ্কিওসাইটিস হয়ে যেতে পারে।
-পানি এনেছি, কেমন লাগছে?
-কি?
-আমি পানি কিনে এনেছি।
- কত রুবেল?( রাশিয়ান মুদ্রা)
- পরে দিও,এখন পানি নাও।
বোতল খুলে ও বেশ কিছু পানি পান করল। আমার হাতে বোতল ধরিয়ে দিল। আমি টিস্যুতে পানি ভিজিয়ে ওর মুখ মুছিয়ে দিলাম,- তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
- তুমি স্বাগতম- তোমার পাসপোর্ট অথবা আইডি কার্ডটা দেখতে পারি? তোমার ঠিকানা জানা দরকার।
ও আমাকে ওর ব্যাগের দিকে ইশারা করল,আমি খুলে আইডি কার্ড আর ফোন পেলাম। দেখলাম পানি বিদ্যুৎ বিভাগের ছাত্রী, দ্বিতীয় বর্ষের। ঠিকানা যা লেখা সেই জায়গা আমি চিনি না।
- তোমার কাছে ফোন আছে? তোমার বাবা-মা কে ফোন করতে চাই.
- আমি অন্য শহর থেকে এসেছি। ফোনে আমার রুমমেট এর নাম্বার আছে
-আচ্ছা দাও দেখি
আমি ওর রুমমেট কে ফোন করলাম, কয়েকবার রিং হবার পর ধরল,সব খুলে বললাম। আমি বললাম আমি জরুরি মেডিকেল সার্ভিস এ ফোন করতে যাচ্ছি ,এবং তার নাম্বার আমি সেখানে দিয়ে দেব। এরপর আমি মেডিকেল সার্ভিস ফোন করলাম,নিজদের অবস্থান জানালাম, তারা আমাকে জানালো ২০ মিনিট পর এখানে উপস্থিত থাকবে।
- শোন একটা কাজ করতে হবে
-কি কাজ,আমি কিছু পারবো না
- আমি পানিতে লবন মিশিয়ে দিচ্ছি,খেয়ে বমি করতে হবে,পারবে?
-জানিনা
আমি পানিতে লবন মিশিয়ে ওকে দিলাম,খেতে বললাম, ও ভয় ভয় চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম। ও পানি গিলল কিন্তু বমির নাম গন্ধ নেই, আমি ওকে গলায় আঙ্গুল দিতে বললাম, এবারে হল। বমির পর অনেকটা স্বাভাবিক হল ও। একটা চুইংগাম দিলাম ওকে চাবাতে। নোনা মুখের স্বাদ দূর করতে।
মিনিট ১৫ পর এম্বুলেঞ্চ আসলো। তারা ওকে তুলে নিয়ে গেল। আমাকে ক্লিনিকের ঠিকানা ফিয়ে গেল। এর মধ্যে আমার দিকে একবারও ফিরে তাকাল না লারিসা। যেন সব ওর অজানা,অপরিচিত। সাই করে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল গাড়ি।

আমি হোস্টেলে ফিরলাম।পরদিন ক্লাস শেষ হল বিকাল ৩ টায়। আমি ক্লিনিকে যাবার কথা চিন্তা করলাম,আবার ভাবি কেন? কি দরকার, মানুষ হিসাবে যতটুকু করার দরকার আমি করেছি। বাকিটা ও বুঝুক। ও যাবার আগে আমাকে একবার ধন্যবাদ ও দিল না। কি দরকার।
কোথা থেকে একরাশ নিরাশা আমাকে এসে চেপে ধরল। কিন্তু ভেতর থেকে তখন ওকে আর একবার অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে। খুব বেশি । সাত পাচ না ভেবে রাস্তায় নামলাম, ফুলের দোকান থেকে ৩ টা গোলাপ কিনলাম।কারন জোড় সংখ্যক ফুল কাউকে দেয়া মানে তার মৃত্যু কামনা করা, আর এক প্যাকেট চকলেট।
পৌঁছে দেখি বিকাল ৪টা। ভিজিটিং আওয়ার শেষ। আমি ফুল আর চকলেট হাতে দাড়িয়ে রইলাম। গোলাপের পাপড়িতে শাদা তুষার জমে অনেকটা দুধে আলতা আবহ তৈরি করেছে। সাহস করে ভেতরে ঢুকলাম। হেড নার্স কে সব খুলে বললাম। নার্স বলল আমরা আপনার কথা জানি, ভেতরে যান, ১৫ মিনিট পাবেন, অফ দা ডকুমেন্ট। চকলেট এখানে ছেড়ে যান, লারিসা যাবার সময় কাউন্টার থেকে নিয়ে যাবে। ক্লিনিকে বাইরের খাবার নিষিদ্ধ। ভেতরে গেলাম। দেখি লারিসা বিছানায় হেলান দিয়ে পত্রিকার শব্দজট মিলাচ্ছে।
-হাই
- আসো, আমি জানতাম তুমি আসবে।
- কিভাবে জানতে?
- এমনিতেই ,মেয়েরা অনেক কিছু যানে। আমাকে কেউ কখনও গোলাপ দেয়নি।
- আচ্ছা,কাল অন্য ফুল নিয়ে আসব।
- না,আমার জন্য এনেছ আমাকে দাও।
আমি ফুল ওর হাতে দিলাম, তখনও ফুলের উপরে কিছু তুষার। হাত দিয়ে নাড়া চাড়া করলে লাগলো লারিসা।
- কি নাম তোমার?
- আমার নাম মীম।
- মীম নামের রাশিয়ান অর্থ জানো?
-জানি
- ফুলের কি নাম দেয়া যায়?
- ইচ্ছা হলেই দেয়া যায়।
- একটা গোলাপ মিম, একটা লারিসা, আর একটা………
-কি?
- বলব না
-কেন?
-ইচ্ছা তাই।
- তোমার জন্য এক প্যাকেট চকলেট এনেছিলাম, কাউন্টারে আটকে দিয়েছে,পরে নিয়ে নিও
- তুমি কোন দেশের
- আমি বাংলাদেশের।
- তাহলে অন্য ফুলটার নাম বাংলাদেশ।
আমি বিছানার পাশে বসলাম। ওর সাথে কথা বলতে লাগলাম, ও সহসা আমার হাত চেপে ধরল, ভেজা গলায় বলল,ধন্যবাদ দেব না, যদি অনেক বিরক্ত করে থাকি রাতে,মাফ করে দিও। আমি বুঝলাম গতরাতের বিষণ্ণতা এখন ওকে আবার চেপে ধরবে,এটা মনস্তত্ত্ব।বিষয়বস্তু খুব দ্রুত বদলানো দরকার। আমি ওর আঙ্গুল নাড়তে লাগলাম।
-বাহ খুব সুন্দর নেইল পলিশ
-বেগুনি রঙ পছন্দ করো?
-খুব বেশি না ,কিন্তু তোমার নখে অদ্ভুত লাগছে।
- তুলে দেবে একটু? আজ রাতে আবার দেব। ব্যাগের মধ্যে স্পিরিট আর তুলো আছে।
আমি আস্তে আস্তে স্পিরিটে তুলো ভিজিয়ে ওর নেইল পলিশ তুলতে লাগলাম ,এই কাজটা আমি আগে কখনই করিনি।আর ওর গল্প শুনতে লাগলাম।
-আবার কবে আসবে?
- জানিনা
- আসলে আমার ভালো লাগবে।
-আমারও ভালো লাগবে।
মুখ ফস্কে কথা বেড়িয়ে গেল।আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম,ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সময় খুব দ্রুত বয়। ১৫ মিনিট পার হয়ে তখন ২০ মিনিট।আমি বেড়িয়ে আসলাম, একবুক প্রশান্তি নিয়ে। মনের মধ্যে তখন অনেক রঙ খেলা করছে আমার।
এরপর বহুদিন পেড়িয়ে গেল। আমি এখনও মাঝে মাঝে ওর নেইল পলিশ তুলে দেই, আর ও হাসে, এই কাজটা এখন ভালই রপ্ত করেছি। আর এর পর থেকে ওর নখে আমি বেগুনি ছাড়া আর কোন রঙ দেখিনি।
ও কোনদিন আমাকে বলেনি অই রাতে ওর কি হয়েছিল, কেন ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলো? থাকনা কিছু কিছু কথা কফিনবদ্ধ। সবার কিছুটা নিজের জায়গা থাকা খুব প্রয়োজন।

এর কিছুদিন পর আমাকে ও খাটি বাংলা হরফে একটা মেসেজ পাঠায় ” আমি বাংলাদেশ থেকে আপনার সঙ্গে যেতে চাও” এই মেসেজ পড়ার আমার গুগল বাংলা অনুবাদককে ইচ্ছে মত মারতে ইচ্ছে হয়েছিল। কারন ও অনুবাদ করেছিল ” i want to go to Bangladesh with you”

আধা ঈশ্বরী




বিশাল লাইব্রেরিতে আমি যখন ঢুকি,একটা বিশাল মানসিক প্রশান্তি পাই। অনেকটা বটতলা বটতলা একটা আমেজ। মাঝে মাঝে বিনা পয়সায় ইন্টারনেট গুঁতাগুঁতি,সব মিলিয়ে খারাপ যায় না সময়।
কোন এক বিকালে বসে আছি সেখানে,এক টেবিলে একা একা। হিবিজিবি চিন্তা ভাবনা করছি। সামনে অবশ্য বই খুলে রেখেছি। আর একটা এটলাস।
খট খট শব্দ ঠিক টেবিলের সামনে এসে থামল। চোখ না তুলেই বুঝলাম মানবী। এমন শব্দ একমাত্র হাইহিল বুট থেকেই আসা সম্ভব।
-আমি কি এখানে বসতে পারি?
বেশ রুক্ষ কণ্ঠস্বর,কেমন একটা ডিক্তেটিং আমেজ,চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, চকলেট। ইয়ে মানে কফি রঙের চামড়া,কালো চুল। কোন ভাবেই রাশান না। একটা মিক্স আছেই।
- বেজ প্রব্লেম( কোন সমস্যা নেই)
বসতে বসতে ত্তাহার আরও দুই মিনিট,একবার এই বই বের করে, তো আর একবার অন্য একটা, একবার এ্যালবাম তো আর একবার পেন্সিল বক্স। যুদ্ধ শেষে রমণী আসন গ্রহন করল।

খুব ব্যস্ততার সাথে এই পৃষ্ঠা ওই পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো জীবন্ত সেই ঈশ্বরী। আকি ঝুকিও করল মিনিট খানেক।
ঈশ্বরীর গা থেকে একটা পারফিউম ভেসে আসে,কিন্তু বুঝতে পারি না কি পারফিউম। মেয়েদের সকল পারফিউম আমার কাছে এক মনে হয়। শেনেল ফাইভ টা চিনি অবশ্য। কিন্তু এ গন্ধ শেনেলের না।
আধা ঈশ্বরী উশ খুশ করতে লাগলো,একটু অস্থির মনে হল- মেয়েরা যেমন হয় আর কি,আবার তার গলা শোনা গেল
- তোমার কাছে একটা ইরেজার হবে?
- কি?
-ইরেজার?
-ও আচ্ছা,হ্যাঁ হবে
- একটু দেয়া যাবে?
- শিওর
আধা ঈশ্বরী এবার ঘষাঘষি শুরু করল,চোখের কোনা দিয়ে দেখালাম, মুহূর্তেই এ্যালবামের শাদা পাতা ধুসর হয়ে গেল। এবার আধা ঈশ্বরী আকিঝুকি শুরু করল। বেশ কিচ্ছুক্ষন নীরবতা। চিত্রটা প্রায় শেষ করে এনেছে আধা ঈশ্বরী। বাড়া ভাতে ছাই দেবার অভ্যাস আমার দীর্ঘদিনের। খেকে গলা পরিষ্কার করলাম,গলা নীচে নামিয়ে বললাম
- কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
- আমাকে?
- হ্যাঁ
- হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই,ইরেজার লাগবে?
- না ইরেজার না
- তাহলে?
- যে ফিগারটা এঁকেছ,সেখানে গলদ রয়ে গেল,টিচার ছিড়ে দেবে নিশ্চিত।
-মানে?
- মানে চিত্রটা ভুল হয়েছে।
- উফ, কোথায় ভুল হয়েছে?
- কোষ গুলো গোলাকার হবে,নিউক্লিয়াস লম্বাকৃতি,বেগুনি রঙের।
- এতক্ষনে বলতে পারলে না,ছবি আকা শেষে কেন বলতে গেলে?
- ইয়ে মানে তোমাকে চিনি না,তাই
- মনে হচ্ছে খুব ভালো ছাত্র?
- না মানে,টিচার টা খুব খাচড়া,বাধ্য হয়ে সব শিখতে হয়েছে।
- ও আচ্ছা
আধা ঈশ্বরী ভগ্ন হৃদয়ে আবার ঘষাঘষি শুরু করল,এবারে পাতার অবস্থা আরও করুণ হয়ে দাঁড়ালো। খুব মায়া লাগলো আমার।
- এইদিকে দাও,একে দিচ্ছি,কবে সাইন করাতে হবে?
-বুধবার। কিন্তু আমার চিত্র তুমি কেন আকবে?
- কারন তুমি পাতার পর পাতা শুধু ঘষেই যাবে
খিল খিল শব্দে আধা ঈশ্বরী লাইব্রেরি ভরিয়ে তুলল। পরক্ষনে নিজেই হাত দিয়ে মুখ চাপা দিল,তাতেও শেষ রক্ষা হোল না, মধ্যবয়সী লাইব্রেরিয়ান চোখ দিয়ে আধা ঈশ্বরীকে ততক্ষণে আধা গিলে ফেলেছেন।

বিবলিওটেকে নি রাজগাভারিভাইয়েম
পা টিশে
( লাইব্রেরি কথা বলবার জন্য নহে – নীরবতা কাম্য)

লাইব্রেরিয়ানের চিৎকার করে উঠল। শুনশান নীরবতা নেমে আসলো লাইব্রেরিতে।
আমি চিত্র আঁকতে লাগলাম, বেশ মনোযোগ দিয়ে,প্রতিভার প্রশ্ন। খারাপ হলে নিশ্চিত দায় নিতে হবে। এর মধ্যেই আধা ঈশ্বরীর প্রশ্নবান শুরু হয়ে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম বিপ্লবীকে কি ১৪৪ ধারা দিয়ে বেধে রাখা যায়? তবে এইবার রয়েসয়ে ফিশফিশিয়ে

- তুমি সিগারেট কেন ফোঁক?
- সেটা তুমি কিভাবে জানলে?
- এপ্রনের পকেট উচু হয়ে আছে, সেল ফোন এত উচু হয় না, তার মানে সিগারেটের প্যাকেট।
- একজন মহিলা শার্লক হোমসের সাথে পরিচিত হয়ে আমি গর্বিত।
- ইউ ক্যান কল মি অগাথা ক্রিসটি
- তুমি রাশান?
- কি মনে হয়?
- আমার অনেক কিছুই মনে হয়
-যেমন?
- ইন্ডিয়ান- রাশিয়ান,ইউক্রেন-আজারবাইজান,বেলারুশ-তাজাকিস্তান
- একটাও হয়নি,তবে আমার মিক্স আছে
- ও আচ্ছা
- আমার তাতার- গ্রীক মিক্স, মা গ্রীক বাবা তাতার।
-জেনে প্রীত হলাম
- নিজের সম্পর্কে বলাটাও ভদ্রতা।
- আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি,কোন মিক্স নেই।
- আমি আন্দাজ করেছিলাম তুমি ইন্ডিয়ান
- আমি বাংলাদেশী
- বাংলাদেশ কি ইন্ডিয়ার একটা শহর না?
- সেটা বেঙ্গালুর,বাংলাদেশ না, তোমার স্কুলের ভূগোল টিচারকে আমার পক্ষ থেকে মিডেল ফিঙ্গার দেখিয়ে দিও।
- কি আশ্চজ্জ, রাগছ কেন?
- তাহলে কি ম্যাপ নিয়ে নাচবো?
- আমি দুঃখিত।আমি সত্যি দুঃখিত।
- স্কিপ।
- তোমার কি নাম?
- আমার নাম মীম।
- ইজন্ট ইট এন আরাবিক এলফাবেট?
- হু
- তুমি মুসলমান?
- মুসলমান ফোবিয়া আছে নাকি তোমার?
- ফোবিয়া নেই,উত্তর এখনও পেলাম না।
- জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়,নিজের ধর্ম নিজের খুজে নিতে হয়।
- এহহহ! খুব দার্শনিক।
- সাধারন লজিক
- পা নাড়িয়ো না, টেবিল শুদ্ধ কাপছে।
- আচ্ছা
- খুব টেনশনে আছো মনে হচ্ছে?
- ইয়ে মানে না, মানে হ্যাঁ।
- কি হয়েছে?
- তোমার যে চিত্রটা আকছিলাম,মানে পুরাই গেছে
- ওয়েল আই টেক দেট এজ আ কমপ্লিমেন্ট।
- কেন কেন?
- চিত্রর দিকে নয়,তোমার মনোযোগ আমার দিকে ছিল।

হতাশ হইয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিলাম। যে প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটাইতে চাইছিলাম,উহা বাস্প হইয়া উড়িয়া গেল,আধা ঈশ্বরী আমার পানে চাহিয়ে তখন মুচকি মুচকি হাসিতেছে। উহাকে অগ্রাহ্য করিয়া আমিও দু পাটি দন্ত বের করিয়া নিঃশব্দে হাসিতে লাগিলাম।
আমি আধা ঈশ্বরীকে কহিলাম
- কফি চলবে, একতলায় মেশিন আছে
- চলতে পারে
- চকলেট?
- একটা মিনি মার্স, দাড়াও পয়সা দিচ্ছি
- অধমের আতিথেয়তা গ্রহন করা হোক, জরিমানা স্বরূপ।
- কিসের জরিমানা
- চিত্র নষ্ট করেছি,এই কারনে।

আধা ঈশ্বরী আবার খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। উহার মাঝেই সেল ফোন বিপ করিয়া উঠিল। আধা ঈশ্বরী ফোন নিয়া ঘাটাঘাটি শুরু করিল, কিছুক্ষন পর আমার দিকে হতাশ চোখে তাকাইয়া বলিল
- আমাকে যেতে হবে, মায়ের মেসেজ
- শিওর। পরিচিত হয়ে অনেক প্রীত হলাম।
- আমিও
আধা ঈশ্বরী হুট হাট করিয়া নিজের বইখাতা ব্যাগে পুরিতে লাগিল। খচ খচ শব্দ করিয়া জ্যাকেট পরিয়া বের হইবার উপক্রম করিল, আমার মনে হইল আমার বাড়া ভাতে তেলাপোকা উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসিল।
জলজ্যান্ত মানবী ২ মিনিটের মধ্যে আমার দিকে হাত নাড়িয়া উড়িয়া চলিয়া গেল। বের হইবার আগ মুহূর্তে টেবিলের দিকে তর্জনী দিয়া কি ইশারা করিল। উহার দিকে আমার তখন খেয়াল নাই, আমি উহার গমন পথের দিকে অপলক চাহিয়া রইলাম।

সিনেমায় মাঝে মাঝে একটা দৃশ্য খুব দেখা যায়। কোন কোন সময়ে কোন মানুষের জন্য সময় স্থির হয়ে যায়,তখন চার পাশ থেকে হু হু করে গাড়ি চলে যায়, কর্মজীবী মানুষ দ্রুত হেটে যায়,বাতি নেভে আর জ্বলে,কিন্তু সময় স্থির হয়ে যাওয়া মানুষটি কিছুই অনুভব করে না। গরুর মতো বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে।
নিজের এই অবস্থা দিয়ে আমি সিনেমার সেইসব সিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। হতাশ হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমি আবার টেবিলে চোখ দিলাম।
একখণ্ড ভাজ করা চিরকুট রাখিয়া গিয়াছে আধা ঈশ্বরী। বুভুক্ষের মতন ঝাপিয়ে পড়লাম চিরকুটের উপর।

” কারো সাথে পরিচিত হবার পর,তার নাম জিজ্ঞাসা করাটা একটা ভদ্রতার পরিচয়। সেটা তুমি বেলামুম ভুলে গিয়েছ,যাই হোক তোমার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লেগেছে, এক কাপ কফি খাবার ইচ্ছে আমারও ছিল। যদি সম্ভব হয় পরে কখন………
নিজের নাম্বারটা রেখে গেলাম,তুমি নিজে থেকে চাইতে পারবে না,বোঝা হয়ে গিয়েছে। আর শার্টের কলার ভাজ করে রাখলেই তোমাকে বেশি ভালো লাগবে, পরামর্শ অযাচিত লাগলে আগের মতন উচিয়ে রাখতে পারো।
- সাবিনা মামেদভা”

চিরকুট পড়িয়া আমি সোজা হইয়া বসিলাম, মেরুদণ্ড বরাবর শিরশির করিতে লাগিল, আমি শার্টের কলার নামাইয়া ভদ্র হইবার একটা ভান করিতে লাগলাম। আধা ঈশ্বরীর নাম তাহলে সাবিনা, বেশ বেশ। মনে মনে এহেন অর্জনে আত্মতৃপ্তির এক বিশাল ঢেঁকুর তুলিলাম।



শীত শেষ হইয়া আসিয়াছে তখন , ঘাস গুলো বড় হইয়া উঠিয়াছে,দুই এক জায়গায় ফুল ও দেখা যায়,সকল গাছে পাতা ধরিয়াছে। আপেল গাছের সবুজ আপেল গুলো সুপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। ইহাকে এক কথায় বসন্ত বলা হয়।
বসন্ত তখন আমার মনেও লাগিয়াছে,সাবিনা আর আমি তখন খুব কাছের মানুষ হইয়া উঠিয়াছি। একসাথে ঘুরিয়া বেড়াই,সাবিনার টিচাররাও বেশিরভাগ আমাকে চিনিয়া রাখিয়াছে। সাবিনা আবার মরদেহ কাটিতে খুব ভয় পায়, আতঙ্কে নাকি উহার বমি পায়,হাত পা অবশ হইয়া আসে। আমি তখন উহার জায়গায় প্রক্সি দিয়া লাশ কাটি, আর সাবিনা আমার বাড়ির কাজ করিয়া দেয়।
আধা ঈশ্বরী মাঝে মাঝে আমাকে খোটা দিয়া বেড়ায়, আমার নাকি উহার সাথে যোগাযোগ করিবার কোন বাসনা ছিল না। সে নাকি নিজে থেকেই আগ্রহী হইয়া ইহা গড়িয়া তুলিয়াছে।
আমি তখন নিঃশ্বাস ছাড়িয়া কই-
” নুন ছাড়া সুপে না হয় তুই একটু লবন দিয়েছিস,উহাতে এত ক্রেডিট লইবার কি আছে?”
আমি আরও কই ভালো বন্ধু পাইবার জন্য এক আধটু ছাড় দিতে হয়।
ইহা ছাড়াও আরও বড় এক সমস্যা ছিল। উহা সাবিনার মা। গ্রীক এই মহিলা কোন এক কারনে আমাকে অসম্ভব পছন্দ করিয়া ফেলেন, মাঝে মাঝেই আমার দাওয়াত পরিত সেই বাসায়,সেই বাসায় আরও একটি প্রাণী ছিল, উহা একটি বিড়াল। বিড়ালের নাম ছিল কিসি। মনুষ্য প্রাণীর মাঝে বড় হওয়া এই বিড়াল খানা ছিল বড়ই নির্লজ্জ, আমাকে পাইলে আমার গায়ে গা ঘষে উহার কিছু লোম আমার কাপড়ে না ফেলিলে উহার শান্তি মিলিত না,সাবিনার মন রক্ষার্থে আমি কিছুই বলিতে পারিতাম না, নিয়ম করিয়া বিড়াল খানার মাথায় হাত বুলাইয়া চুক চুক শব্দ করিতাম।
নিজের রন্ধন প্রতিভা নিয়া বড়ই গর্বিত সাবিনার মা,আমাকে প্রায় দিন এটা সেটা রাধিয়া খাওয়াইতেন। খোলা মেলা বলিলে, উনি বিভিন্ন রান্নার পরীক্ষা নিরিক্ষা করিতেন,আর সেই সব অখাদ্য চাখিতে হইত আমাকে। উনি খুব গাজর প্রেমী ছিলেন, ওনার হাতে আমি গাজরের কত আইটেম খাইয়াছি গুনিতে পারিব না।
তবে এই মিষ্টিভাষী মহিলাকে আমি বড়ই শ্রদ্ধা করিতাম, বিদেশের মাটিতে ওনার মতো একজনকে খুজিয়া পাওয়া দায়।
একদিন উনি বিশাল এক গ্লাস গাজরের জুস হাতে লইয়া আমাকে ডাকিতে লাগিলেন,আমার হাতে ধরাইয়া দিলেন উহা। গন্ধে আমার অর্ধ ভোজন হইয়া গেল। এক চুমুক দিয়া দ্বিতীয় চুমুক দেবার সাহস যোগাইতে পারিলাম না।
- কেমন হয়েছে
- আন্টি জাস্ট অসাম। আপনার জুসের হাত আসলেই ভালো
আমার আন্টি গর্বে ফুলিয়া গেলেন, নিজের হাতের গ্লাস এক চুমুকে নিঃশেষ করিয়া আমার দিকে তাকাইয়া রহিলেন, এহেন দুরাবস্থায় আমার এক খানি খাটি বাংলা প্রবাদ মনে পড়িয়া গেল
” রাধুনির হাতে পড়িয়া রুই মাছ কাদে
জানিনা রাধুনি মোরে কেমন করিয়া রাধে”



ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়ানো আমাদের খুব শখ ছিল,তবে সাবিনার সময় হইত না,তিনি আবার নাচ শেখেন, ব্যালেট নাচ। ইহা এক রকম শিল্প। নাচের মাধ্যমে একটি গভীর বিষয়কে তুলিয়া ধরা। তবে বেশির ভাগই প্রেম তুলিয়া ধরা। খুব ধীর গতির কারনে অনেকেই এই নাচ পছন্দ করেন না। তবে আমার বেশ লাগে।
কোন এক সন্ধায় আমি আর সাবিনা নাচ দেখতে গেলাম, সিট পাইলাম ব্যলকনিতে। এই জায়গা থেকে নাচ দেখতে অপরূপ লাগে।
বেশ কিছুক্ষন পর আমি উশ খুশ করতে লাগলাম

- এই শোন
- বল
- না কিছু না
- মীম জালাইস না আমারে, আর্ট দেখতে দে
- আচ্ছা ঠিকাছে দেখ।
- না বলে ফেল
- ইয়ে মানে,একটা কথা বলার ছিল
- বল না, তোর মুখে কয়লা কে দিয়েছে?
- এমন করছিস কেন?
- তাহলে বলে ফেল
- মানে, মানে খুব কঠিন কথা,তোর মনোযোগ নেই,পরে বলি
- এখন বল, আমার মন এখানেই আছে
- ও আচ্ছা
- কই বল?
- কি বলব?
- আমি কি জানি?
- তুই না বলবি,শুধু শুধু জ্বালালি কেন?
- তুই জানিস না?
- না জানিনা।
- যা জানলে নাই, নাচ দেখ, পারলে নিজে গিয়া নাচ

আমি মেজাজ খিচে মনোযোগ দিয়া নাচ দেখিতে লাগলাম, মাথার মধ্যে গরম পানির মতো মগজ ফুটছে। সহসা কনুইতে নখের আচড় অনুভব করলাম,ঘুরে তাকালাম রাগি চোখে।
আধা ঈশ্বরী আমার চোখে চোখ রাখিয়া কহিল ” জানি,জানি আমি সব, বুঝি। কাপুরুষ কোথাকার,নিজে থেকে বলতে পারলি না,এখন নাচ দেখ”
আমি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললাম, নাচের দিকে মন দিলাম। আমার কাধে তখন আধা ঈশ্বরীর মাথা,চুল থেকে অদ্ভুত সুন্দর শ্যাম্পুর গন্ধ আসছে,কিন্তু ঝামেলা হোল এই শ্যাম্পুর গন্ধও আমি আলাদা করতে পারি না, সব শ্যাম্পুর এক গন্ধ মনে হয়।
আধা ঈশ্বরী এক হাতে আমার হাত ধরে রাখে, আর এক হাতে আমার কনুই আঁচড়াতে থাকে।

বাতি নেভানো হলরুমে আবছা আলো ছায়া খেলা করতে থাকে ওর চোখে মুখে। অদ্ভুত সুন্দর এক প্রতিমা।
কিছু কিছু উপমা আসলেই খুব বাড়াবাড়ি রকমের সত্য,তার মধ্যে একটা হল
” অর্ধেক মানবী সে অর্ধেক ঈশ্বরী”

সেন্ট পিটার্সবার্গ
রাশিয়া,২০১১

( লেখার মাঝে ইচ্ছে মতো সাধু চলিত মিশিয়েছি, সাধু গদ্যরীতির প্রতি আমার প্রচণ্ড আসক্তি থেকেই এই গুরুচন্ডালি দোষ। আশা করি সবাই এড়িয়ে যাবেন)


অধরা ফাইনাল


আমার মা বলেন ছেলেদের সৌন্দর্য আচরনে আর কাজে। আমি অবশ্যই এই কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেই সব সময়।
দুপুরে খেলা দেখতে যাবো,এই উত্তেজনায় সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। মিষ্টি আর পরোটা দিয়ে জম্পেশ একটা খাওয়া দিলাম। পলাশি মোড়ের দোকানগুলো একটু ময়লা হলেও খাবার বানায় বেশ। পেট ডলতে ডলতে সবাইকে ফোন দিলাম। সবাই রেডি।

আমি সাবান ডলে গোসল করে,গায়ে ২-৩ টা স্প্রে ছিটায় নেমে পড়লাম রাস্তায়। শাহবাগ জাদুঘরের সামনে সবার সাথে দেখা। কেমন একটা চাপা উত্তেজনা সবার মধ্যে। আমাদের মধ্যে সব থেকে কৃপণ রাসেল দেখি চায়ের বিল দিতেছে। সে এক ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য। সবাই বলল বাংলাদেশ আজকে জিতলেই ফাইনালে। কি নাকি মাথায় মাথায় টাকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে ( হেড টু হেড) আমি ক্রিকেট একটু কম বোঝার চেষ্টা করি। এত হিসাব বুঝি না,কি সব রানরেট,বোনাস পয়েন্ট এই সব আর কি। আমি নিজে মেরে খেলতে খুব ভালবাসি।

ক্যাডেট কলেজে জরুরী এক ম্যাচে হিসামের এক ফুলটস বলে সামনে এসে ব্যাট চালাতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গিয়েছিলাম,তখন থেকেই মূলত আমার ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। যেহেতু আমি বাংলাদেশী অর্থাৎ যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষন আঁশ। আমি আম্পায়ারের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালাম। সোজা হেটে চলে গেলাম তার কাছে তাকে বোঝাতে থাকলাম কেন ফুলটস বলটি তার নো বল কল করা উচিত। কিন্তু তিনি আমায় তাবুর পথ দেখলেন। এছাড়াও বরিশালের গৌরনদী সরকারী কলেজ মাঠে নিজ শাখার ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নেমে প্রথম বলে শূন্য রানে আউট হওয়া আমার জলন্ত ক্যারিয়ারের আর একটি কলঙ্ক।

স্মৃতিচারণ করতে করতেই হিসাম চলে আসলো। দেখেই মেজাজ বিষিয়ে গেল। এসেই নিকোটিনের সরবরাহ করল। ওর উপর থেকে রাগ ঝেড়ে ফেললাম। আমার সবার কাছ থেকে আরও কিছু খাবার ইচ্ছে ছিল। এই যেমন চটপটি/ কলিজার সিঙ্গারা/ ঝালমুড়ি। কিন্তু সবাই খুব তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে পরল সাথে আমিও। কি গাদাগাদি, বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। একহাতে আমি হ্যান্ডল ধরে আছে অন্য হাতে পেছনের পকেটের মানিব্যাগের অবস্থান নিশ্চিত করছি।
ভাড়া নিতে আসলে সবাই অর্ধেক ভাড়া দিল। এইটা নাকি ছাত্র ভাড়া। ছাত্র হয়ে ফুল ভাড়া দেয়া নাকি খুবই অসম্মান জনক। আমি ছাত্র সমাজের সম্মান বজায় রেখে অর্ধেক ভাড়া ধরিয়ে দিলাম। বাসের মধ্যে আমাদের মতো অনেক খেলা দেখা পাবলিক। এরাও যাচ্ছে। এক পাশে দেখলাম কিছু রমণীও বাংলাদেশের পতাকা গালে মুখে একে বসে আছে। ব্রন ঢাকার জন্য না দেশপ্রেম বুঝবার পারলাম না ঠিকমত। যাই হোক গুরু হিসাম সবসময় বলেন যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। আমি এক মেয়ের চোখে চোখ মিলাইয়া মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে লাগলাম। উহাও আমাকে দেখে বেশ মুচকি হাসি দিতে লাগলো। প্রথম পর্ব পাশ করা গিয়েছে ভেবে আমি দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তুতি নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম,অর্থাৎ কথা বলতে হবে,সজারুর মতো মাথার চুল উচু হইয়া আছে কিনা জানা দরকার,আমি হাত দিয়া চুল ঠিক করতে গেলাম,এই সময় বাস ব্রেক করল। আমি ভারসম্য হারিয়ে প্রায় উশটা খাবার জোগাড় করিলাম,পাশের বন্ধুর প্যান্ট বেল্ট ধরে পতন রোধ করলাম। আমার এমন অবস্থা দেখে সেই মেয়ে খিল খিল শব্দে হাসিয়া উঠল,আর পাশের মেয়েদের এই কাহিনী রস মাখিয়ে বলতে লাগলো।
আমি ভগ্ন হৃদয়ে উহার সাথে হালকা রোমাঞ্চের আশা ছাড়িয়া চুপ চাপ দাঁড়াইয়া রইলাম।

এক যুগ পর বাস আসিল মিরপুর। দরজার অপেক্ষা করতে পারলাম না, জানালা দিয়ে নেমে গেলাম। চোখের সামনে মুসলিম সুইটস এর বড় সাইনবোর্ড
- হিসাম শোন,তোর এক মামা না মুসলিম সুইটস এর মালিক?
- তো কি হইছে?
- না মানে খুব তৃষ্ণা পাইছে, একটা কোক খাওয়াবি?
- তুই বিদেশ গেছস ঠিক আছে,কিন্তু তোর আচরন এখনও বরিশালের মতই আছে।
আমি কোক পাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুই পাটি দাত বের করে একটা হাসি দিলাম হিসামের উদ্দেশে। উহাকে যদিও খুশি মনে হইল না। হিসাম আমাকে একটা হাফ লিটার কোক এনে দিল। আমি কোক খুলে গিলতে লাগলাম,আর ওকে বুঝাইতে লাগলাম কোক কত ক্ষতিকর,এবং কেন খাওয়া ঠিক নয়( ডাক্তারি দৃষ্টিকোন থেকে) বলতে বলতে আমার কোক সাবাড় হয়ে গেল,আমি ওকে বললাম
_ থ্যাংকস বাডি

ও মনে হয় মৃদু একটা গালি দিল,আমি গায়ে না মেখে ওর সাথে নিকোটিন শেয়ার করে দলের অন্যদের ধরার জন্য পা চালিয়ে হাটতে লাগলাম।
হায় হায় হায় বাংলাদেশে নাকি মানুষ ১৬ কোটি। আমার মনে হোল ২০ কোটি। এত মানুষ ক্রিকেট খেলা দেখে! ইশ হতাশ হয়ে ক্রিকেটটা না ছাড়লেই ভালো হত,মনে মনে নিজেকে খুব গালি দিয়ে নিলাম।

এত ভিড়। কিভাবে ঢোকা যায়। কোন উপায় নেই। মানব সমুদ্র। আমি হিসামকে বললাম সময় নষ্ট করে লাভ নাই,দুই প্যাকেট ঝালমুড়ি চলুক,সরিষার তেল একটু বেশি হবে সেই সাথে ঝাল ও। হিসাম আমার দিকে তাকিয়ে আরও কিছু গালাগালি দিল। বরিশালের সব ছেলেই নাকি এমন,আমি গায়ে মাখলাম না কারণ বরিশালের সবাই কেমন তা দিয়ে আমার কাম নাই,আমি জানি আমি ভালো ছেলে। তাছাড়া কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। নিমিষেই ঝাল মুড়ি শেষ হয়ে গেল। আমি বললাম এভাবে দাড়িয়ে থাকার কোন মানে নাই লাইনে,দ্রুত ঢুকতে হবে ভেতরে। পরে নাহয় জায়গা পাওয়া যাবে না। ও জিজ্ঞাসা করল কিভাবে? আমি শারলক হোমস মার্কা হাসি দিয়ে বললাম চল। ঢুকে পড়লাম জনসমুদ্রে। ঠেলাঠেলি করতে লাগলাম সমানে,গেট থেকে তখন ও মিটার সাতেক দূরে। চোখ টিপলাম হিসামকে,এবং সেই সাথে সাথে বমি করার ভাব,বার বার হেচকি তুলতে লাগলাম,আর মুখ থেকে থুথু ফেলতে লাগলাম,লোকজন জামাকাপড় নষ্ট হবার ভয়ে সড়ে দাঁড়ালো,আমি বললাম শ্বাস নিতে পারছি না, আবার বমির ইমো,হিসাম আমাকে ধরে সামনে আগাতে থাকলো। সবার চোখে সহানুভূতি দেখতে পেলাম।

গেটের পুলিশ আমাকে আপত্তিকর ভাবে সার্চ করল,এখানে ওখানে পেষণ সহকারে,যাদের সুড়সুড়ি আছে তারা কিভাবে মাঠে ঢোকে বুঝতে পারলাম না আমি। ভেতরে প্রবেশ করে আমি বিজয়ের হাসি ঝাড়লাম হিসামের উদ্দেশে। হিসাম বলল আমি বিদেশে থাকি এরকম কোন ছাপ আমার মধ্যে নাই। আমি মুচকি হেসে বললাম “ ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে” তোর ইচ্ছে করলে তুই ফেরত গিয়ে আমার মুড়ি, মানে ঝাল মুড়ি খেতে পারিস,পরে লাইনে দাড়িয়ে ঢুকিস। প্রত্তিউত্তরে বেশ কিছু গালি ধেয়ে আসলো,এগুলো গায়ে মাখার কোন কারণ নেই,যখন প্রতিভার স্ফুরন ঘটে মানুষ তখন বিপক্ষে অবস্থান নিতে থাকে। এই যেমন বিজ্ঞানী ব্রুনো।

যাই হোক সিট পছন্দের বিষয়টা বন্ধুদের উপর ছেড়ে দিলাম,বহু মাতব্বরি করেছি আর না। খেলা ততক্ষনে শুরু হয়ে গিয়েছে। পকেট ডিনামাইট মুশফিক নাকি ফিলন্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিছে। বোকা ক্যাপ্টেন। কে যেন বলেছিলেন টসে জিতলে ব্যাট করো,দ্বিতীয়বার ভাবো তবুও ব্যাট করো,পিচ ভেজা থাকলেও ব্যাট করো। এই কথা সবাইকে বলতেই সবাই দেখলাম আমাকে গালি দিচ্ছে। যাই হোক খেলা দেখতে থাকলাম। বোরিং খুব বোরিং,যতক্ষণ দিলাশান আছে ক্রিজে ততক্ষন চুপচাপ বসে থাকাই ভালো। দিলশান সেই রকম সব মাইর মারতে লাগলো অফ সাইড দিয়ে,দিলশানের মাঝে আমি আমার নিজের শৈশবের শট খেলার ছাপ দেখতে পেলাম স্পষ্ট। সেই সাথে আগে ব্যাট করা কেন দরকার সবাইকে বুঝতে লাগলাম। দিলাশান একের পর এক শট খেলে আর আমার বিরক্ত লাগে। আমি মাথায় সানগ্লাস উঠায় এক জোড়া সুন্দর চোখ খুজতে থাকি। সহসা জয়াবর্ধনে বোল্ড হয়ে গেল। যাক একটা পিলার পড়ছে,রইল বাকি দুই আমি আশা ফিরে পেলাম।

বাহাতি সাঙ্গাকারা আসলো। সাঙ্গাকারার বউএর সাথে একবার হোটেল শেরাটনে আমার দেখা হইছিল। খুব সুন্দরী আর অমায়িক ভদ্র মহিলা। আমাকে মনে হয় একটা অটোগ্রাফ ও দিছিলেন,কই যেন হারায় ফেলছি, উফ আমারে দিয়ে কিছুই হোল না, আউট,আউট আউট। সাঙ্গাকারার বিলাসী কাভার ড্রাইভ নাজিমউদ্দিনের তালুবন্দি। আমি এবার চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গেলাম। নড়ে চড়ে বসা দরকার। ম্যাচ সমানভাবে বিষাক্ত এখন। যে কারো দিকে পেন্ডুলাম ঝুলে পড়তে পারে।
আমি সবাইকে বললাম যেহেতু আকাশে মেঘ আছে বাংলাদেশ পরে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভালো করেছে। দেখে শুনে খেলা যাবে। সবাই আমার দিকে চোখ কুচকে তাকাল।
কিছুক্ষন পর দেখি আবার নাযমুল বেটা। হায় হায় দিলশান বোল্ড। আমার মতো কাট শট খেলতে গিয়ে বোল্ড। এবারে আমি গেঞ্জি খুলে নাচতে লাগলাম। বন্ধু বান্ধব আমাকে টেনে ধরে বসিয়ে গেঞ্জি পরতে বলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন? সবাই বলল আশে পাশের সবাই নাকি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। হুম বুঝতে পারলাম বিদেশে গিয়ে আমার রঙ ভালই ফর্সা হয়েছে।

উফ এর পর কি বোরিং। জীবনে কোনদিন কাপুগেড্রারে ভালো খেলতে দেখি নাই, ১২, ১৩ বরজোড় ৩০ এর ঘরে। সে দেখি হাটু গাইড়া বইসা সুইপ পিটায়। মেজাজ চরমে উঠল। সেটা আবার রাজ্জাক ভাইয়ের বলে। রাজ্জাক ভাই আমার প্রিয় খেলোয়াড় সবচে। এমন গালি দিলাম কাপুগেদ্রারে,সে শুনলে নিশ্চিত খেলা ছেড়ে দিত।
যখন কেউ বোর হয় তখন তার আইসক্রিম কেন খাওয়া প্রয়োজন,এইটা বিশ্লেষণ করতে বসলাম হিসামকে। মানসিক চাপ মুক্তিতে আইসক্রিম কেমন বড় একটা ভূমিকা রাখতে পারে এই দিয়ে শুরু করলাম। হিসাম সরাসরি আইসক্রিম অলাকে ডেকে আমাকে একটা আইসক্রিম কিনে দিল। সবুজ কালারের আইসক্রিম ভিতরে লেবুর গন্ধ। আমি আইসক্রিম খাওয়াতে মন দিলাম। খাবার পরে প্যাকেট কই ফেলব তাই নিয়ে বিপদে পড়লাম। দেশের বাইরে সব জায়গায় ডাস্টবিন থাকে এখানে নেই কেন,এই নিয়ে সরকার,আমাদের সমাজ ব্যবস্থা,সংস্কৃতি এর উপর চরম বিষেদাগার ঝেড়ে দিলাম। কেউ একজন বলে উঠল
“ পুরান পাগলের ভাত নাই,নতুন পাগলের আমদানি”
আইসক্রিমের প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে গুজে রাখলাম। রাখতে রাখতেই
বাপরে বাপ
মুশফিকের কি লাক!
আউট হয়ে গেল সেট ব্যাটসম্যান। তারপর মড়ক লাগলো,স্প্রে মারলে যেমন একটা একটা তেলাপোকা টপটপ করে পরে,ব্যাটসম্যানরাও তেমন পরতে লাগলো। রাজ্জাক ভাইয়ের লাইন লেংথ দেখে পুরানো রেস্পেক্ট ফিরে আসলো আবার। সেই সাথে এই শাকিব ছেলেটা। খুব বুদ্ধিমান প্লেয়ার। নিজের একটা ছাপ দেখতে পেলাম এই দুজনের মধ্যে।

গড়াতে গড়াতে সিংহরা কিভাবে কিভাবে ২৩২ রান করে ফেলল। আমি বললাম হায় হায় এখন কি হবে। বাংলাদেশের সব ব্যাটসম্যান ভালো খেলে ফেলছে অলরেডি। সাকিব,তামিম,নাসির,মুশফিক সবাই। কারো কাছ থেকেই তো কিছু পাওনা নাই। সবাই বলল ধুর,ম্যাচ জিতবো।

এর মধ্যে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি নিয়ে রবি ঠাকুরের কি একটা গান মনে করতে করতে শেষ পর্যন্ত মনে আসলো না। ধুর একটা মানুষ এত গান এত কবিতা লিখলে কি মনে থাকে নাকি কিছু।
বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য সিট ছেড়ে ছাউনি এর নীচে চলে গেলাম। সেখানে এত মানুষ,সবাই জামা কাপড় বাচাতে সেখানে জমা হয়েছে।
শাদা জামা আর নীল জিনস পরা একটা মেয়ে দেখলাম গা বাচাতে চেষ্টা করছে বৃষ্টি থেকে। আমি একটু সরে জায়গা করে দিলাম। সে মুখ ঘুরিয়ে বলল থ্যাংকস।
বৃষ্টিভেজা চুল,কপাল চুইয়ে টপটপ করে জল পড়ছে,হাতে ব্যাগ আর টিস্যু,সেই টিস্যু দিয়ে জল মোছার চেষ্টা করছে,টিস্যু ভিজে ছিড়ে ছিড়ে ওর মুখে লাগে থাকতে লাগলো।
আমি বললাম আপনি স্বাগতম।
_ আপনার সারা মুখে টিস্যু লেগে আছে।
- ও আচ্ছা। দেখছি।

ও সারা মুখ ঘষতে থাকলো,টিস্যুর একটা টুকরো গিয়ে ঢুকল চোখে। আমি আরও ১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করলাম,এখন শুরু হয়েছে চোখ ঘষা। পাশের বান্ধবী দেখি চোখের পাতা খুলে আঙ্গুলে বের করে আনতে চাইছে টিস্যু।
এখন একটু ডাক্তারি না ফলালেই নয়। বললাম থামুন,কি করছেন,চোখ খুয়াবেন।
দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বললাম আপনি চোখ বন্ধ করুণ,এখন এক আঙ্গুল দিয়ে করে মাসাজ করুণ,আস্তে করে নাকের পাশে নিয়ে আসুন মাসাজ করে,যখন অনুভব করবেন টিস্যু নাকের পাশে চলে এসেছে,চোখ খুলবেন। সেকেন্ড ১৫ পর দেখলাম,চোখ খুলল সে,আস্তে করে নাকের পাশ থেকে টিস্যু সরাল তারপর। ততক্ষনে তার চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। পানিও বের হচ্ছে একটু একটু।
- আপনাকে থ্যাংকস।
- আপনি আবারো স্বাগতম। এভাবে একজনের চোখে আর একজনের খোঁচাখুচি করা ঠিক না। এটা নাটক সিনেমায় দেখার জন্য উপাদেয় রোম্যান্টিক সিন,বাস্তবে না ঘটলেই ভালো।
- আপনি ডাক্তার নাকি?
- না।
এই অংশটা খুব নার্ভাস। আমার খুব ভালো লেগেছে ওকে,এখন কিভাবে বলি,কিভাবে আরও একটু কথা বলা যেতে পারে।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। সবাই আস্তে আস্তে নিজেদের সিটের দিকে যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম সেও চলে যাবে।
- কোথায় বসছেন?
- ওই তো ওই কোনে
- আপনারা দু জন?
- জী
- আমাদের সাথে চলে আসুন,একসাথে বসে ব্যাটিং দেখা যাবে।
ও একটু ইতস্তত করতে লাগলো,ওর বান্ধবিকেও বললাম,সে দেখলাম মহা উৎসাহী। চলে এলাম আমি সদলবলে। সবাই দেখলাম কেমন একটু আড়চোখে তাকায় আমার দিকে। বসে বসে আরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা,একটা পেপার কিনে পড়তে লাগলাম। নিজে নিলাম সম্পাদকীয় পাতা,বাকি সবাইকে ভাগ বাটোয়ারা করে দিলাম খেলা,বিনোদন, শেষ পাতা ইত্যাদি।
সম্পাদকীয় পাতা পড়লে একটা ভাব আসে। যে ভাবটা অন্য পাতা পড়াতে নেই।
এর মধ্যে ওর সাথেও টুকটাঁক গল্প করতে লাগলাম,ওর বান্ধবীটা বেশ বাচাল,আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করে। কই থাকি,কি করি।এই রাতেও আমার মাথায় সানগ্লাস কেন ইত্যাদি। যার সাথে কথা বলতে চাই,সে তখন চুপ চাপ বসে আছে আর একটু একটু কাপছে। বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস নেই বোধহয়।

শুরু হোল ব্যাটিং। হায় নাজিমের সেই বিলাসী শট,বোল্ড। ব্যাপার না,সবাইকে সান্ত্বনা দিলাম,জহুরুল ঝানু খেলোয়াড়, ৮ বছর ঘরোয়া লীগ খেলছে। ঝাঁকড়া চুলের মালিঙ্গা সমানে বাউঞ্চার দিয়ে ছেলেটাকে কাপায় দিতেছে। খুব খারাপ লাগলো। কোন মতে জহুরুল ঠেকায় দিল ওভারটা। পরের ওভারে ওরে বাপ,সমস্ত শক্তি দিয়ে জহুরুল পুল করতে গেল,আমি মনে করলাম ৬ না হলেও ৪ তো হবে,দেখি সার্কেলের মধ্যে ক্যাচ।
সবাইকে বুঝিয়ে বললাম যে ফুটওয়ার্কে ঝামেলা আছে, ফ্রন্ট ফুটে এই শট সবাই খেলতে পারে না,এবং আমি কলেজ জীবনে এই শট খুব ভালো খেলতাম।
এবারে কেউ কিছু বলল না,মনে হোল দু জন মেয়ে আমাকে কিছু গালি হজম করা থেকে বাচিয়ে দিল।
মুশফিকের জুয়া মুশফিক হারল। ৪ নাম্বারে একটা ভালো ব্যাটসম্যান এর অভাব বোধ করলাম খুব। মুশফিকের বোল্ডের পর হিসামকে বললাম তোর কি মনে আছে ৪ নাম্বারে আমি কলেজে কিভাবে ধরে ধরে ব্যাট করতাম? হিসাম দাতে দাত খিচে বলল আছে। মনে আছে।
এই দিকে সেই মেয়ের মোবাইল বাজে,আমি ভেবে নিলাম ছেলেবন্ধু। মনটাই ভেঙে গেল। পরে দেখি না, বাসা থেকে। ফোন ধরল সে,কি কি বুঝাবার চেষ্টা করল তার মাকে। ও পাশ থেকে শুধু চিৎকারই শুনলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে, আমাকে সে বলল বাসা থেকে চিল্লানি দিচ্ছে, এত রাত,এবং বৃষ্টি। দুয়ে মিলে যা দাঁড়ালো সেটা হোল তাকে এখনি বাসায় ফিরতে হবে।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ধুরমুর করে উঠে দাঁড়ালো দুই বান্ধবী। আমি ওকে বললাম নাম্বারটা রেখে যান,আমি মেসেজ দিয়ে খেলার খবর দেব।
ও বেশ কিছুক্ষন চিন্তা করে আমাকে নাম্বারটা দিয়ে গেল। যাবার সময় আর একবার হাত নেড়ে বাই বলে চলে গেল।
মেয়েদের প্রতি অভিবাবকদের আরও অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন,এবং তাদের আরও অনেক বেশি স্বাধীনতা দেয়া উচিত, এই জাতীয় একটা লেকচার ঝাড়তে শুরু করলাম,কিন্তু সবার সিরিয়াস মুড দেখে অফ গেলাম।
হায় হায় মেয়েটার নামই জানা হোল না। একটা মেসেজ ঝেড়ে দিলাম “ আপনার নাম কি জানতে পারি?”
উত্তর এল “অধরা”।

খেলা জমে উঠছে তখন চরম ভাবে। দল থেকে প্রায় বাদ পরা তামিম উইকেটের চার দিকে শট খেলতেছে। তার মধ্যে আবার নাকি তার জন্মদিন আজকে। একদম ঘিয়ের মধ্যে আগুন। ওপর পাশে শাকিব মারে খালি ক্লাসিক শট।
দুই জনের ৫০ হয়ে গেল। তামিম আরও একটা ৪ মারল। একটু তারপর আউট।
সবাইকে আমি বুঝিয়ে বললাম যে এটা টেকনিক না টেম্পারমেন্টের অভাব। ৫০ গুলোকে ১০০ করা খুব জরুরী।
মাঝে মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম খেলার খবর। ধন্যবাদ জানালো আমাকে অধরা। এরপর সাকিবরে আউট দিয়ে দিলেন আম্পায়ার। বুঝতে পারলাম না কতটা ক্লোজ।
শেষ ভরসা নাসির- রিয়াদ। এই জুটি বেশ দেখে শুনে খেলে দিল। ম্যাচ বের করতে তখন মাত্র ৩২ রান দরকার। মেসেজ পেলাম অধরা বাসায় পৌঁছেছে।
এরপর আর কি বলব উৎসব আর উৎসব,একটা ৪ মেরে ম্যাচ জেতালো নাসির। চিৎকার আর চিৎকার। বাংলাদেশ ফাইনালে। ভারত বাদ। পাকিস্তান বাংলাদেশ ফাইনাল।
সমস্ত মাঠে এক চিৎকার জয় বাংলা,জয় বাংলা,জয় বাংলা।

মাঠের চার দিকে ভিক্টরি ল্যাপ দিল বাংলাদেশ দল। সবাইকেই দেখলাম,রাজ্জাক ভাই খুব স্ল দৌড়ায়,বল ভালো করে কিন্তু ফিল্ডিঙে উন্নতি করা দরকার রাজ্জাক ভাইয়ের। এমন কথা বলতেই বেশ কিছু গালি হজম করলাম।
সব কিছু দেখা শেষ করে হিসামের সাথে নিকোটিন শেয়ার করতে করতে বললাম,এশিয়ার সেরা বোলিং তো বাংলাদেশের। শুধু শাহাদাতটা কেমন মাইর খায়।
এই সব হিবিজিবি করতে করতে ফোন করলাম অধরাকে।
- কি খবর
- এই তো,ভাত খেলাম মাত্র। আপনারা কোথায়?
- জয় নিয়ে বের হলাম মাত্র। আপনিতো দেখতে পারলেন না খেলা।
_ হুম খুব খারাপ লাগছে, মা খুব টেনশন করছিল
- তো সমস্যা কি ফাইনাল দেখবেন
- আমার কাছে টিকেট নেই তো।
- আমি আপনার জন্য একটা টিকেট নিয়ে রাখবো,আসবেন আপনি?
অনেকক্ষন নীরবতার পর সে বলল আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। এখন রাখি পরে কথা হবে। আমি নিজেও একটা ঘোরের মধ্যে কথাগুলো বলে ফেলেছি। এখন খুব লজ্জা লাগছে। আর ওর লজ্জা পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
এত ভালো লাগছিল,অনেক হালকা মনে হচ্ছিল নিজেকে,আমার গেঞ্জি তখনও শুকায়নি, বাতাসে খুব ঠাণ্ডা লাগছিল। আরও একটা গান মনে করার চেষ্টা করলাম মনে মনে এবারে ঠিক মনে মনে পরল
“ তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম…………।।“

হিসামকে বললাম চল তোকে নান আর কাবাব খাওয়াবো। ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আমি গ্রাহ্য না করে মিরপুর ১০ নাম্বারের দিকে হাটতে লাগলাম।

কাল একটা দিন,তারপর ফাইনাল। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের। আর আমার সেমিফাইনাল। অধরার সাথে আরও একবার দেখা হবে।

উলঙ্গ রাজারা


যে কারনে লিখছি,সেটা হোল সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং তার বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন।

ব্যক্তিগত ভাবে সায়ীদ স্যারকে আমি খুবই সম্মান করি,উনি একটি বইপড়া মুক্তচিন্তা করতে পারা জাতি চান। প্রমথ চৌধুরীর একটা লাইন মনে পড়ে,তিনি বলেছিলেন হাসপাতালের থেকেও গ্রন্থাগার জরুরী। পক্ষে বিপক্ষে যদিও অনেক কথা চলে,তবু গ্রন্থাগারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
সায়ীদ স্যার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি। তিনি যে কাজ হাতে নিয়েছেন,যে আলোর পথে মানুষকে আনছেন বলাই বাহুল্য যে উহা মহান।
সায়ীদ স্যার এর যে একটা লাইন আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে যায় সেটা হোল
“ মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়।“

যাই হোক আমাদের নির্বাচিত সাংসদেরাও মহান,গণতন্ত্রের বাহক। জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছেন। সংসদ অধিবেশনে তাহারা বিভিন্ন বিল পাশ করে নিয়মিত দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করছেন।
অধিবেশনে এই ঘটনার সূত্রপাত করেন সাংসদ ফজলুল আজিম। তিনি অবশ্য আগে ভাগেই এমন হুংকার দিয়েছেন,মন্ত্রী এমপিরা জাতির বাপ মা,এদের না খেপানোই মহৎ ও সমীচীন।

তিনি সংসদে একটি মহা উৎকর্ষ সাধন করিবার অভিপ্রায়ে,নোটিশ উপস্থাপন করেন,সেখানে সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়। নোটিশের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, ‘‘সবাই উত্তরা যাওয়ার সময় মাথার ওপরে (ওভারব্রিজ) দেখে শুধু ফজলুল আজিম সাহেবরা দেখেন না, ওনারা দেখে শুধু সরকারের ব্যর্থতা।
তিনি অবশ্য অর্থনীতি নিয়েও প্রচণ্ড সরব। সংসদে তার জ্বালাময়ী বক্তব্যগুলো বেশ শ্রুতিমধুর। তিনি বলেন, ‘‘অর্থনীতির সবগুলো সূচকেই আমাদের দেশের অর্থনীতির ভরাডুবি ঘটেছে। শেয়ারবাজারের পতন সর্বশেষ পর্যায়ে চলে গেছে। গত এক সপ্তাহের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- শেয়ারবাজার একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘অথচ অর্থমন্ত্রী কিছু করতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী একজন ভালো মানুষ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। প্রধানমন্ত্রী যেখানে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সেখানে অর্থমন্ত্রী পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। এই অর্থমন্ত্রী দিয়ে কিছু হবে না।’’
ফজলুল আজিম বলেন, ‘‘আমি মনে করি, এই সংসদে যোগ্য ব্যক্তির অভাব নাই। সুতরাং দেশের অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে অর্থমন্ত্রীর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত। আর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’’

এই সংসদে যোগ্য ব্যক্তির অভাব নাই এই লাইনের সাথে ফজলুল আজিমের মিল খুজে পেলে পাঠক দায়ী থাকবেন।

আমার এক মামা প্রায় সর্বশান্ত হয়ে গেছেন শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে। মামা বলেন “বিদ্যুৎ,আর শেয়ার বাজার ঢাকায় লীগের সব আসন খুয়াবে।“ উল্লেখ্য গত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকার সবকটি আসনে জয় লাভ করে নৌকা মার্কা।
এই শেয়ার বাজারের ভরাডুবির কারণ খুজতে গিয়ে যদি পাঠক চুরি ও টাকা ওলট পালটের গন্ধ পেয়ে থাকেন,সেটি কাকতালীয়। আমাদের অর্থমন্ত্রী শেয়ার বাজার বোঝেনই না,অতএব সকল রকম গন্ধ পাওয়ার সুযোগ নাই।

শেখ ফজলুল করিম সাহেবের কথা বলতে গেলে তো ব্লগের কাগজ ফুরিয়ে যাবে। শেখ পরিবারের এ বীর সন্তান বহু আগে থেকেই জাতি উদ্ধার করে আসছেন।

২০০৭ সালে গ্রেফতার হন শেখ ফজলুল করিম,ও আচ্ছা তিনি একাধারে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ফুপাত ভাই। আজম চৌধুরী নামক এক ব্যবসায়ীর মামলায় গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে।

রিমান্ডে থাকা আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম অকপটে স্বীকার করেছেন যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আংশিক কাজ থেকে তিনি ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ মার্কিন ডলার নিয়েছিলেন। এছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে প্রতি মাসে নিতেন ৩ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন বলে শেখ সেলিম জানান। (সূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক)

অস্ত্র দেখিয়ে ডাকাত যখন ডাকাতি করে সেই ঘটনার সাথে এই ঘটনার মিল খুজে পেলে পাঠক দায়ী থাকবেন।

আজম চৌধুরী তার মামলায় বলেন, ২০০০ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ও শেখ সেলিম স্বাস্খ্যমন্ত্রী থাকাকালে টেকনো প্রম নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যুৎ প্লান্টের প্রথম ধাপটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায়। কিন্তু আজম চৌধুরীকে শেখ সেলিম জানান যে, ‘কমিশন’ প্রদান না করা হলে শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বìধ করে দেবেন এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে টেকনো প্রমের পাওনা পরিশোধ আটকে রাখতে বলবেন। এ পরিস্খিতিতে আজম চৌধুরী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের আটটি চেকের মাধ্যমে শেখ সেলিমকে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা প্রদান করেন। শেখ সেলিমকে ২৯ মে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আদালতে প্রকাশ্য শুনানিতে স্বীকার করেন যে, তিনি ইস্টকোস্টের কাছ থেকে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা আদায় করেছিলেন এবং শেখ হাসিনার সাথে তা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (এসিসি) তদন্তকারীরা শেখ হাসিনা ও শেখ সেলিমের অ্যাকাউন্ট থেকে চেকগুলোর অস্তিত্ব পান।

জানতে ইচ্ছা করে আজম চৌধুরী কোথায় আছেন,কেমন আছেন? অবশ্য রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে প্রান যায় উলুখাগরাঁড়। সবাই হয়ত ভালো আছেন।

এসব রূপকথা লিখে আর কত আপনাদের মনে ব্যথা দেব? বিষয় বদলানোর দরকার।

আরেক বিদায়ী মন্ত্রী আবুল হোসেন তো খুবই জনপ্রিয় মন্ত্রী। তার কথা বলতে গেলে দিস্তার পর দিস্তা ফুরিয়ে যাবে।
নিন্দুকেরা বলে তিনি নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খামখেয়ালীর সুযোগ নিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। বিশ্বাস করা বা না করা আপনার নিজস্ব মতামত।
চীন সফরে তিনি অনির্ধারিত দৌড় প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেই সাথে জিতে নেন মন্ত্রী গদিও। ( হাততালি এবং মারহাবা ইমো)
আবুল হোসেন সাহেবের মেয়েও অবশ্য কম যায় না। পাকি প্রেমের জলন্ত উদাহরন দিয়েছেন মেহেরজান চলচিত্রের মাধ্যমে আবুলের মেয়ে রুবাইয়েত হোসেন।উনি বলছেন ছবিটা দর্শকরা নাকি গ্রহন করছে। পাকি প্রেম আর কাকে বলে। সরকারকে অবশ্যই তদন্ত করতে হবে এই আবুল হোসেন সেন্সরবোর্ডকে কত উপটৌকন দিয়ে ছবি রিলিজ করেছে।সরকারের টনক না নড়লে তার খেসারত আমাদের সকলকেই দিতে হবে।মুক্তি যুদ্বের হাজার করুন এবং আনন্দের ঘটনা থাকতে আবুল তনায়া আমাদের বীরঙ্গনাদের এবং মুক্তিযুদ্বাদের হেয় করার জন্য এই ছবি নির্মান করেছেন।

সেন্সর বোর্ডে মাটির ময়না আটকে থাকা এবং মেহেরজান এর মুক্তি পাবার মধ্যে টাকা পয়সার গন্ধ পেলে,পাঠক দায়ী থাকবেন।

তবে আবুল হোসেন সাহেব খুবই ধর্মভীরু লোক। যার প্রমান আবুল হোসেনের কাছে হিন্দুরা একটি আশ্রামের সাহয্য চাইতে আসলে মুখের উপড় বলে দেন আমি মসজিদ ছাড়া সাহয্য দেই না। ( সুবাহানআল্লাহ্‌,এবং নারায়ে তাকবির ইমো হবে)
পদ্মা সেতু নির্মান,আর সেই বিষয়ক চুরি চামারির খবর সংগ্রহ করে পড়বার দায়িত্ব পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম। আসুন আমরা সবাই নিজে করি নীতি মেনে চলি।

কাওরান বাজারে দেখা হয়েছিল সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক সাহেবের সাথে। তিনি তো জনগণকে কম খাবার পরামর্শ দিয়ে রীতিমত সেলিব্রেটি। ভাগ্যিস সংসদে এমন কোন বিল পাশ হয়নি।

ফার্মগেট-গাবতলী লোকাল বাসের ভাড়া তোলা ছোকড়াও মন্ত্রী এমপি দের চোর বাটপার বলে গালি দিয়ে থাকে। তবে পাঠক গালি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন,কারণ গাল পাড়লে মামলা হয়ে যেতে পারে। জুটতে পারে সংসদ অবমাননা অথবা রাষ্ট্র দ্রোহের মামলা।

ডক্টর ইউনুসকে নিয়ে কে কাটা ছেঁড়া হোল সেটা দেখলে আমাদের এনাটমি ল্যাবের বহুবার ব্যবচ্ছেদিত লাশও লজ্জা পাবে।

মন্ত্রী এমপি সংসদ আমাদের গনতন্ত্রের ধারক সমূহ,এদের অপমান করা থেকে বিরত থাকুন।

হুট করে মনে পড়ল শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর কথা। তিনিও মাথায় রাষ্ট্র দ্রোহের মামলা নিয়ে মারা গিয়েছিলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।এরপরের ঘটনা বড়ই নির্মম !তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যায়। একদিকে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের রাজনৈতিক বান্ধব দলের মানুষরুপী পশুদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া, অন্যদিকে রাস্ট্রপক্ষের মদদপুষ্ট হয়ে সরাসরি আক্রমন করে বসে ৭১ সালের হায়েনাদের দল- গোলাম আযম নিজামী গং। জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে মামলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহীতার।অবশেষে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা মাথায় নিয়েই আমাদের জননী জাহানারা ইমাম ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে দেশের বাইরে মিশিগানে ইন্তেকাল করেন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণআদালত সংগঠিত করার দায়ে বিএনপি সরকারের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা নিয়েই জাহানারা ইমাম মারা যান।
গুণীজন আর রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। গুণীজণের গুনের বহর বিবেচনার ক্ষেত্র রয়েছে,এমপি,মন্ত্রীদের সাথে লাগতে গেলে গুনের বহর কেটে মামলা,আর নিন্দা লেখা হয়ে যাবে।

বহু ফিরিস্তি দিলাম,ফিরিস্তি দেখে নিশ্চয় পাঠক বিরক্ত? তাই এবারে একটু আনন্দ লাভ করুণ,পড়ুন একটি কবিতা। কবিতার নাম উলঙ্গ রাজা,লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আমাদের মনে রাখতে হবে রাজা রাজাই,সে উলঙ্গ হোক অথবা বোরখা মোড়া। তার শরীরে কাপড় না থাকলেও আমাদের ভেবে নিতে হবে রাজ প্রাসাদের মসলিন কাপড় খুব বেশি মিহি। তাই শরীর দেখা যাচ্ছে। ঢাকাই মসলিন কাপড় যদি ম্যাচ বাক্সের মধ্যে ভাজ করে রাখা যায়,রাজাদের মসলিন কাপড়ের জায়গা হয়ে যাবে আরও ছোট কোন জায়গায়।

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

Sunday, June 10, 2012

৭১ এর জেনোসাইড (নিক্সন-কিসিঞ্জার)


বটমলেস বাকেট অর্থাৎ তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বিখ্যাত উক্তি কম বেশি আমরা সবাই শুনেছি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের কথা(তালিকা দেবার প্রয়োজন বোধ করছি না) আমরা সব সময় হৃদয়ে রাখবো। কিন্তু একজন বিদেশী যুদ্ধাপরাধীর কথা না বলে আর পারছি না, মানবতা পায়ে ঠেলার মতো উপমা শুনেছি,হেনরি কিসিঞ্জারের কথা জেনে উদাহরণ জানার বিলাসিতাও হয়েছে।

ব্যবচ্ছেদ করলে একটা সহজ সমীকরণে আসা যায় খুব সহজে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো ছিল,ভারত,তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন। আর ঘোরতর বিরোধী ছিল যুক্তরাষ্ট্র,চীন এবং সৌদি আরব। ইতিহাস এবং দলিল এদের প্রমাণ দেবে।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই পাকিস্তানের সপক্ষে তার নীতি ঘোষণা করে। তারা গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তারা দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা অগণতান্ত্রিক শক্তির সপক্ষে। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড এম. নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন নিক্সনের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি, যিনি তখন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রেসিডেন্টের একান্ত সহকারী।

এই নিক্সন-কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত মার্কিন নীতিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানের এমন একটি অত্যাচারী সরকারের সপক্ষে দাঁড়াল যে সরকার তার পূর্বাঞ্চলের নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রকাশ্য সমর্থন কিংবা পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া নীতি অনুসরণ নিছক পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা ছিল না। তখনকার মার্কিন প্রশাসনের নীতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়, যা ঐ ঝুঁকে পড়ার সীমা ছাড়িয়ে যায়। বলা যায়, প্রায় অনেকটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তথা পাকিস্তানের সপক্ষে আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কিংবা মদদদান। আমেরিকা ঐ অবস্থান গ্রহণ করার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পাকিস্তানকে সামরিক ও নৈতিক সমর্থন জানায়।

পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন প্রশাসনের ঝুঁকে পড়ার নীতির এক বলিষ্ঠ প্রয়োগকারী ব্যক্তি হচ্ছেন- হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী ও পারদর্শী। কিসিঞ্জার তাঁর নিজের উচ্চতর ক্ষমতা ও যোগ্যতার অধিকারী হয়ে এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সমীকরণের বলে তিনি এমনই একজন শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন যার ফলে তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আবির্ভূত হন।

নিক্সন-কিসিঞ্জার ছিলেন একাত্তর সালের বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকার নীতি নির্ধারণে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁরা গোপনে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারাই ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার সপ্তম নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের নির্দেশ দেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বোচ্চ ভীতিপ্রদান এবং পূর্ববাংলা থেকে সরে আসতে পাকিস্তান যেন কিছু সময় পায়।

এ ছাড়াও ব্লাড টেলিগ্রাম এর কথা বলতে হয়। আর্চার কেন্ট ব্লাড একজন মার্কিন নাগরিক যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেমে মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দিয়েছলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জারের পাকিস্তানপন্থী অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাকেঁ “বাংলাদেশের যুদ্ধবিবেক” হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে, পূর্ব পাকিস্তানস্থ মার্কিন দূতাবাসে পলিটিক্যাল কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে। আর্চার ব্লাড তাঁর দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ বইয়ের সূচনায় লেখেন, ‘একাত্তর নিয়ে লিখতে বসে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কারণ আমার বহু বন্ধুর মুখ ভেসে উঠছে, যারা শহীদ হয়েছে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু করে। ৬ এপ্রিল ১৯৭১ ঐতিহাসিক মার্কিন দূতাবাস থেকে একটি তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কর্মকর্তারা ২৫ শে মার্চের ‘কলঙ্কিত রাতের’ গণহত্যা এবং সে বিষয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের অন্ধ ইয়াহিয়া-ঘেঁষা নীতির প্রতিবাদ জানাতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন।

তাঁরা খুব ভেবেচিন্তে একটি তারবার্তা লিখেছিলেন যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ব্লাড ও তাঁর ২০ জন সমর্থক সহকর্মী। তাঁরা তাতে ঢাকায় ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত নীরবতার নিন্দা করেছিলেন। ব্লাড তাতে কেবল স্বাক্ষরই দেন নি, বাড়তি এক ব্যক্তিগত নোটও লিখেছিলেন। এতে তিনি রিখেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।“ এই ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ বস্তুত তখনকার নিক্সন-কিসিঞ্জারের দুর্গে বোমা ফেলেছিল। ‘’দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’’ নামীয় গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স মতে ‘মার্কিন ইতিহাসে ব্লাড টেলিগ্রামের কোনো তুলনা নেই।’ কিসিঞ্জার এ জন্য ব্লাডকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন।

ক্রিস্টফার হিচেন্স তার দি ট্রায়াল অফ হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ের একটি পর্বে বাংলাদেশ,৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিবর্তী কিসিঞ্জারের ভূমিকা সম্পর্কে লেখেন।
আর একটি কথা না বললেই নয়,কিসিঞ্জার শুধু বাংলাদেশ জেনোসাইড নয়, পৃথিবীর আরও বেশ কয়েকটি দেশের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে তার যোগ থাকার বিষয় নিশ্চিত করা হয়।

হিচেন্স এর বইটির যে পর্বে বাংলাদেশ কথা ও কিসিঞ্জারের কথা উল্লেখ রয়েছে সে পর্বটি অনুবাদ করছি।
অনুচ্ছেদ- বাংলাদেশ

পৃষ্ঠা-৪৪

১৯৭১ সাল গণহত্যা শব্দটি বিশ্বের দরবারে খুব পরিচিত করে তোলে!! ততকালীন সময়ে পাকিস্তানের ‘বাঙ্গালী’ জনগোষ্ঠির, তথা বাংলাদেশীদের পক্ষে ইউনাইটেড স্টেট কনসিউলেট তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি বার্তা পাঠায়। বার্তাটি পাঠানো হয় ৬ এপ্রিল ১৯৭১, যেখানে প্রধান স্বাক্ষরকারী ছিলেন তৎকালীন ঢাকার কনাস্যিউল জেনারেল আর্চার ব্লাড। অন্য অর্থে এটাকে হয়ত ব্লাড টেলিগ্রামও বলা যেতে পারে! মার্গেন্থাসের বিবরনী থেকে ভিন্ন এই বার্তাটি সরাসরি ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়, যেখানে গনহত্যার বিষদ বর্ণনার চেয়ে গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকার সরকারের ভূমিকা নিয়ে বেশি সমালোচনা করা হয়। এর মূল বক্তব্য ছিলঃ
‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সরকার সাধারণ জনগনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রন করতে , এমনকি বিশ্বের দরবারে তাদের আসল রূপ প্রকাশেও তারা সক্ষম হয়নি যা কিনা অন্যান্য দেশের সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সাক্ষী আমাদের সরকার, আর হাস্যকরভাবে ঠিক একই সময় তারা গনতনত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠায়, যেখানে পূর্ব পাকিস্থানের প্রবল জনপ্রিয় এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ ভাবে বিজয়ী নেতাকে আটকের প্রতিবাদ করা হয়। সেই সাথে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধের আহবানও জানান হয়……… কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নিরব দর্শকের ভূমিকা নেই- এমনকি মানবিক দিক থেকেও। এটি একটি দেশের অভ্যন্তরীন বিষয় বলে আমরা স্রেফ মুখ বুজে রইলাম যা একসময় গনহত্যায় রূপ নিল! সাধারন আমেরিকানরা এখন এর প্রতিবাদ করছে, সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে আমরাও সরকারের এই নিরবতাকে সমর্থন করি না, বরং আশা করছি সরকার এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রেখে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।‘
এই বার্তাটিতে তৎকালীন বাংলাদেশে বসবাসরত বিশ জন আমেরিকান কূটনৈতিকের সাক্ষর করেন, পরবর্তীতে স্টেট ডিপার্টমেন্টে আসার পর আরো নয় জন কর্মকর্তা এতে একাত্নতা প্রকাশ করে সাক্ষর করেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমাদের স্বাধিনতার স্বপক্ষে এটাই সবচেয়ে জননন্দিত এবং শক্তিশালী বক্তব্য ছিল।
২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন রাজধানী ঢাকা আক্রমন করে,এবং শেখ মুজিবর রহমান কে অপহরন করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুজিব অনুসারি এবং সাধারন জনতাকে লক্ষ্যহীন করা। সমস্ত বিদেশী মিডিয়াকে ঢাকা থেকে জোর পূর্বক বের করে দেয়া হয়,ততকালীন ম্যাসাকারের সরাসরি প্রমান পাওয়া যাবে,মার্কিন রেডিও থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারকৃত বার্তা সমুহে। আর্চার ব্লাড নিজে সরাসরি একটি বার্তা তখন কিসিঞ্জারের অধিকৃত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে পাঠান।
সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা তখন সাধারন মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়া শুরু করে,এবং মানুষগুলোকে গুলি করে হত্যা করে।( এই বন্দুকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এসিসটান্ট প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল)
এই সময় লন্ডন টাইমস এবং সানডে টাইমস যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে,এন্থনি মাসকারহেনাস এর সেই প্রতিবেদন গুলো তারা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রচার করে কালো রাতের মুখোশ উম্মোচন করে। খুন,ধর্ষণ,এবং সাধারন মানুষের উপর অত্যাচারের সেই রিপোর্টগুলো মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শিশু ও নারী হত্যা করে সেনাবাহিনী তখন সাধারন মানুষকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
প্রথম ৩ দিনে ১০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা যায়,পরের কয়েকদিনের হিসাবে যা মিলিওন এর হিসাবে গিয়ে ঠেকে।
সকল হিন্দু ধর্মালম্বী জনগন তখন বাস করছিলেন একটি নারকীয় পৃথিবীতে।
প্রায় ১০ মিলিওন উদ্বাস্তু মানুষ তখন ভারত সীমানা পথে যাত্রা শুরু করে।
পুরো জেনসাইড কে তিনটি পয়েন্টে বর্ণনা করা যায়
১) সাধারন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জটিলতার অবতারনা।
২) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে একটি আগ্রাসি সিধান্তের উদাহরন।
৩) সল্প সময়ের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ক্রাইসীস সৃষ্টি।
নিউ দিল্লিতে অবস্থান রত তৎকালীন মার্কিন কূটনিতিক কেনেথ কেটিং বাংলাদেশের সাধারন মানুষের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি ছিলেন সাবেক নিউ ইয়র্ক সিনেটর, তিনি ২৯ মার্চ মার্কিন প্রশাসনকে বলেন “ “promptly, publicly, and prominently deplore this brutality” এছাড়াও তিনি এই বর্বর অপারেশন অবিলম্বে বন্ধ করতে প্রশাসনকে সতর্ক করে দেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন “ “prior to inevitable and imminent emergence of horrible truths.”

নিক্সন ও কিসিঞ্জার এই বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেন,আর্চার ব্লাডকে তার পদ ঠেকে অব্যাহতি দেয়া হয়,আর কেটিং কে বলা হয় যাতে তিনি তার ভারত ঘেঁষা আচরন শুধরে নেন। তাকে সরাসরি বলা হয় “taken over by the Indians.”

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে,ঠিক যখন গনহত্যার হার সব ঠেকে উচু,হেনরি কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খানকে একটি বার্তা পাঠান,যেখানে কিসিঞ্জার ইয়াহিয়াকে তার সময়োপযোগী সাহসী সিধান্ত ও কূটনীতির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

নিক্সন- কিসিঞ্জারের এই পাকিস্তান প্রশাসন ঘেঁষা মনোভাব,ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধ অপরাধ সমর্থনের কারণ খুজতে গেলে আরও একটি বিষয় উঠে আসে।
কেন নিক্সন- কিসিঞ্জার জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানিয়েছিল?
এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দলকে চীনের বেইজিং এ একটি ট্যুরনামেন্ট খেলতে আমন্ত্রন জানানো হয়,মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করা হয় পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতকে। এবং সেই রাষ্ট্রদূত টেবিল টেনিস খেলার আমন্ত্রন পত্রের সাথে চীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য একটি নৌ বহর পাঠানোর সুপারিশ নিয়ে আসেন। নিক্সন- কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক রাজনীতির দখল নিতে মিত্র পক্ষের সমর্থন পাবার নিমিত্তে,লাখ লাখ মৃত্যুগামী জনগণকে জেনে শুনে আগুনে ফেলেছেন,নীরবে সমর্থন দিয়ে গেছেন সেই সেনাবাহিনীর অপারেশনকে। কি নির্মম,বর্বর ক্ষমতালোভী দুজন রাজনীতিবিদ।

পৃষ্ঠা – ৫০

যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে তার বিতর্কিত ভুমিকা নিয়ে কিসিঞ্জারকে সাংবাদিকদের বেশকিছু বিব্রতকর এবং বিদ্রুপাত্মক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল,যা তার আনন্দঘন চীন ভ্রমনের অনেকটাই ম্লান করে দেয়।তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং নেতাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন,এবং শেখ মুজিবকে তিনি(তার তৎকালীন সহকারী রজার মরিস এর ভাষ্যমতে) Salvador Allende এর সাথে তুলনা করেন।

১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জার সেক্রেটারি অব স্টেট হওয়া মাত্রই,গনহত্যার প্রতিবাদে যোগদানকারী প্রত্যেকেই তার তীব্র রোষের সম্মুখীন হয়।

১৯৭৪ এর নভেম্বরে কিসিঞ্জার একটি সংক্ষিপ্ত এবং দায়সারা উপমহাদেশ সফরকালে বাংলাদেশে আটঘন্টার একটি যাত্রাবিরতি নেন,এবং তিন মিনিটের একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন। সেখানে ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে তিনি কেন নৌ-বহর পাঠিয়েছিলেন জানতে চাওয়া হলে,তিনি উত্তর দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।তার ফিরে যাবার তিন সপ্তাহের মধ্যে, এখন আমরা জানি,ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একাংশ বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের একটি দলের সাথে গোপন সাক্ষাৎ শুরু করে,যারা মুজিবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল। ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট,মুজিব এবং তার পরিবারের ৪০ জন সদস্য একটি সামরিক হামলায় নিহত হন।এর কয়েকমাস পরে,তার কিছু নিকটতম রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও কারাবন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

জন্ম পদ্যের গদ্যরূপ


এই রকম একটা লেখা লেখার কোন ইচ্ছাই ছিল না,তবুও লিখছি। স্মৃতিচারণে পুরনো লেখা পড়তে জুড়ি নেই।
আজ ২৫শে মে। আমার জন্মদিন। সেই সাথে সাথে নজরুল জয়ন্তী। তবে আজ কবি নজরুলের ঢোল না পিটিয়ে নিজের ঢোল পিটানোর জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

তুষখালি ও আমি

আমার জন্ম এইসব কংক্রিট পাথর ইটের শহরগুলো থেকে অনেক দূরে। বর্তমান পিরোজপুর জেলার,মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালি নামক ইউনিয়নে। তুষখালি আমার মামাবাড়ি।
তুষখালি কেন নাম হোল জায়গাটার,এই প্রশ্ন করেছি বহুজনকে,কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি কারো কাছে থেকেই,এক এক জন এক এক রকম কাহিনী ফাঁদে। তবে তুষখালির কিছু বিজয়গাথা রয়েছে।

জমিদারেরা তখন শাসন করত পুরো বাংলা,কিন্তু ধীরে ধীরে এক সময় বিভিন্ন কারনে কৃষকদের সাথে জমিদারদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, এই বিরোধের পরিণামস্বরূপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভ থেকে ঐ শতকের আশির দশকে জমিদার বিরোধী কয়েকটি বড় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এগুলোর মধ্যে একটি বড় বিপ্লব হোল তুষখালি কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫)।

এই ইউনিয়নের মানুষজন এখনও কৃষিকাজ ভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করে। এবং এই অঞ্চলের মানুষজনের বিদেশ যাবার হার মারাত্মক, এবং প্রথম পছন্দ তাদের মধ্যপ্রাচ্য। কুয়েত,সৌদি,কাতার,দুবাই ফেরত পাত্র এখানে সবচে দামি। এখানে অধিকাংশ পুরুষের গলার সোনার চেইন,সোনা রঙের ঘড়ি,এবং বাড়িতে বিদেশী জায়নামাজ। এখানকার মানুষের কাছে এখনও বিদেশ মানে টাকার কাড়ি,গাড়ি,বাড়ি আর ভালো বিয়ের সম্বন্ধ।

তুষখালির আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হোল ধানখেতে মাছ চাষ,বিভিন্ন রকম কার্প মাছ,রুই মাছের চাষ করা হয়। অনেক সময় জোয়ারের পানি অধিকবৃষ্টিতে ফুলে উঠে ঢুকে পড়ে খেতে, সাথে,কাঁকড়া,মাছ,সাপ আর ব্যাঙ। তখন এখানকার মানুষরা ছাতি,টর্চ আর হাতে ছররা( বাশের মাথায় লোহার কাটা বসানো) নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মাছ মারতে।

বাংলাদেশে গিয়েছিলাম গত জুলাইয়ে,দু মাস ছিলাম দেশে। নিজের জন্মস্থানের প্রতি নাকি মানুষের টান থাকে প্রবল। বরিশাল থেকে বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেলাম তুষখালি। নেমেছিলাম মাছ মারতেও,সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে,ঠাণ্ডা লাগিয়ে আর ভোর রাতের দিকে জলঢোড়া সাপের কামড় খেয়ে বাসার ফিরেছি। ছোট মামি আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড হাসাহাসি করলেন, রাঙ্গাদি ( নানি) বললেন
“ ছররাটা তুলে রাখ মাচায়,সামনের বছর যখন আসবি তখন মারবি আবার”

আমি খুব ফলপ্রেমী,তুষখালির প্রতি আমার ভালোবাসার আরও একটি কারণ এটা। লিচু আর জাম্বুরা গাছ প্রায় প্রতি বাড়িতে, ফল হচ্ছে দেদারছে,সাথে আম কাঁঠাল আর পেয়ারা।
যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন তাদের বাগানে আরও আছে ডাব,ছফেদা,জামরুল।
আর খাল পাড়ের গাব গাছের গাব সবার জন্য উন্মুক্ত। আকারে বড়,এবং মিষ্টি শাঁস ওয়ালা গাবকে বলা হয় বিলাতি গাব,আর ছোট,পানসে গাবকে বলা হয় দেশী কিম্বা প্যাঁচরা গাব।
নামকরনের সার্থকতা উদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়েছিলাম,লোকে বলে বড় গাব আংরেজ সাহেবদের মতো দেখতে,বড়সড়,লাল টকটকে আর মিষ্টি, আর পেঁচরা গাব কষ( ক্ষারীয়) । আমি মিষ্টি হেসে আমার নিজস্ব সমর্থন জানালাম,এবং অনুভব করলাম জাতি হিসেবে নিজেদের আমরা কুৎসিত ভাবতেই পছন্দ করি।
তবে যখন সিডর আঘাত করল তখন ফল গাছ প্রায় সব মুড়িয়ে দিয়ে গেছে, এখনও বেচারারা আগের রূপ যৌবন ফিরে পায়নি।

ইতিহাস

আমার নানা আর নানির কথা একটু বলি,নানা গত হয়েছেন। ক্যান্সার বাসা বেধেছিল শরীরে। নানা যখন মারা যান আমি তখন বেশ ছোট,বুঝতে শিখেছি মাত্র। এতটুকু বুঝেছিলাম নানা আর নেই,মসজিদের পাশে উচু ঢিবির নাম কবর,নানা সেখানে শুয়ে আছেন,আমার মা কাদছেন অতএব আমারও কাদা উচিত।
আমার নানা খুব সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে স্টুয়ার্ড ছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার আগের মাসে তিনি করাচী ত্যাগ করেন গোপনে,চাকরি থেকে ইস্তফা না দিয়েই। আমার মায়ের বয়স তখন ২ মাস। বাচ্চা ছোট তাই যুদ্ধে যেতে পারেননি পারিবারিক কারনে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নানা আশে পাশের অনেক হিন্দু বাড়ির মেয়েদের নিজের ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। এলাকায় নানার প্রচণ্ড সুনাম।

শেষ বয়সে একবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন,কি সব কারনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করা হয়ে ওঠেনি নানার। দেশ স্বাধীন হবার পর নানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার হন। চাকরি করেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মায়ের মুখে শুনেছি আমার নানা আমার নানিকে বিয়ে করবার জন্য ৭ দিন নানী বাড়ির কাছারিতে ( বসার ঘর) অপেক্ষা করেছেন,নানির বাবা শেষ পর্যন্ত এই নাছোড়বান্দা যুবকের হাতেই তার মেয়ে তুলে দেন।
নানীর বাড়ি তুষখালি থেকে নৌকায় ৬ ঘণ্টা ( যখন গিয়েছিলাম তখন নৌকায় গিয়েছিলাম,সড়ক পথের দূরত্ব জানা নেই আমার) জায়গাটার নাম চিত্রা। অসম্ভব সুন্দর এক গ্রাম,একবারই যাবার সুযোগ হয়েছিল চিত্রায়। নারিকেল গাছ থেকে নামার সময়ে আমার বুকের ছাল ছড়ে গিয়েছিল,তখন মা সহ ফিরে আসতে হয়েছিল চিত্রা থেকে।

আমার মা যখন সন্তান সম্ভবা তখন নানা নানি তাকে তুষখালি নিয়ে যান,এটা সম্ভবত আমাদের দেশের একটা ট্রাডিশন। কথা ছিল মে মাসের মাঝের দিকে মেজ মামা মাকে নিয়ে বরিশালে ফিরবেন, সেখানে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে আমার জন্ম হবে,বাবার চাকরিও তখন বরিশাল এবং আমার এক ফুপিও বরিশালে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের আর যাওয়া হোল না বরিশাল,আমি জন্ম নিলাম তুষখালিতে। যে বিছানায় মা আমাকে প্রসব করেছেন,সেই খাটটা এখনও আছে,হাত বুলিয়ে দেখেছি,যদিও জন্ম অনুভব করতে পারিনি।

নানা বড় অফিসার হওয়াতে তিনি আমার জন্মের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন সঠিকভাবে। তখন তার চাকরির পোস্টিং নড়াইলে,সেখান থেকে চলে এসেছেন তুষখালিতে। মঠবাড়িয়া হাসপাতালের ডাক্তার মাকে দেখে যাচ্ছেন নিয়মিত সপ্তাহে একবার করে,ঘোষণা দিয়েছেন কোন রকম অস্রপচার ছাড়াই মা সন্তানের জন্ম দেবেন। মাঝে একবার মাকে এসে দেখে গেলেন ডাঃ রুস্তম আলি ফরাজি। উনি বিএনপি সরকারের সাংসদ,এবং ফ্রি চিকিৎসা করার কারনে তুষখালি মঠবাড়িয়াতে প্রচণ্ড প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ডাঃ রুস্তম আলি ফরাজী আমার নানির খালাতো ভাই। মাকে দেখার পর তিনি আরও কিছু গরিব রোগী দেখেন,এবং ওষুধ লিখে দিয়ে যান।

মে মাসের ২৫ তারিখ সকাল থেকে মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হয়,ভোর ৬ টার সময়ে। সাথে সাথেই ডাক্তার ডেকে আনতে মঠবাড়িয়া শহরে চলে যান কয়েক বাড়ি পরের মফাজ্জল নানা আর সাথে আমার মেজ মামা। তিনি তখন বেকার,মসজিদে আজান দেন পাঁচ বেলা,আর সন্ধ্যায় মাছ বাজারে গিয়ে জুয়া খেলেন।
যাই হোক,সেই সাথে নানি ডেকে আনেন আমেনা খালাকে। তিনি আগে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করতেন,স্বামী মারা যাবার পরে ছেড়ে দিয়েছেন চাকরি। তার এক ছেলে ঢাকা থাকে,ব্যবসা করে এবং তাকে টাকা পাঠায়। আমেনা খালা ছাড়া তখন তুষখালিতে আর কেউ ইঞ্জেকশন দিতে পারতো না,তাই লোকে তাকে বেশ সম্মান করত।
ডাক্তার আসলেন,আমেনা খালা আসলেন,আমার ছোট মামা,মেজ মামা নানা আর নানি।

দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার,বেলা ১২ টা ৪৫ মিনিটে আমার জন্ম হোল। আমেনা খালা আমাকে কোলে নিয়েছেন সবার প্রথমে,তার পর নানি। নানির হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়েছেন মেজ মামা। মাতৃগর্ভ থেকে বেড়িয়ে প্রথম চুমু পেলাম মেজ মামার কাছে,এবং তখনও আমাকে পরিষ্কার করা হয়নি। আমার মাও ধাতস্থ হয়ে এসেছেন অনেকটা। মায়ের পাশে শুয়ে আছি আমি,পাশে মামারা। জন্মদানের পর আমার মায়ের কি অনুভূতি হয়েছিল জানতে চেয়েছিলাম। মা বলেলেন
“ আমার মনে হয়েছে আমি বড় একটা গোলাপ ফুল প্রসব করেছি।”
বেশ বড়সড় আকারে জন্ম নিয়েছিলাম ওজন ছিল ৯ পাউন্ড। এই জন্যই হয়ত মায়ের এই অনুভূতি। আর সব মায়ের কাছেই তার সন্তান সুন্দর। বরিশালে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে
“হউলের পোনা,চ্যাঙের পোনা
যার রক্কে হের হোনা”
অর্থ- শোল মাছের পোনা অথবা টাকি মাছের পোনা, নিজেদের পোনা তাদের কাছে সোনা।

দেখতে কার মতো হয়েছি তখনও বলা যাচ্ছে না,সবাই উদঘাটন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মধ্যে কে যেন বলল রঙ হয়েছে নানার মতো,আমার নানা দুই গাল প্রশস্থ হাসি নিয়ে বারান্দায় বসলেন,এবং ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে চা ও নাশতার দিকে মনোযোগ দিলেন,সাথে ছেড়ে দিলেন উচ্চস্বরে রেডিও, পাকিস্তান থেকে আনা রেডিও। তখন বাংলাদেশ বেতারের যুগ। নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে বেতারে চলছে আবৃতি “ বল বীর……………… শিখর হিমাদ্রির”

অভাগা আমি তখন শুয়ে আছি,আমার কানে আজানের আগে ঢুকল বিদ্রোহী কবিতা। যখন বেতারে জহুরের আজানের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তখন সবার টনক নড়ল,খোজ পাঠানো হোল মফাজ্জাল নানার। তিনি তখন পুকুর ঘাটে গোসল করছেন। উনি এলেন এবং আমার কানে আজান দিলেন। কিন্তু কি লাভ!! সর্বনাশ যা হবার তো হয়েই গেছে।

ডাক্তার হিমেল সরকারকে ২০০০ টাকা নিতে বললেন আমার নানা,কিন্তু হিমেল সরকার কোন ভাবেই টাকা স্পর্শ করে দেখেননি। বহু চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে আমার নানি তার একখানা জামদানি শাড়ি উপহার দেন ডাক্তার হিমেলকে। বিবাহিত ডাক্তার সেই উপহার ফিরিয়ে দেননি।
কে জানত আমার জন্ম,জন্ম দিয়েছিল আরও একটি কাহিনীর,যার সূচনা সেই দিন থেকেই।
সে কথায় পরে আসছি, জন্মের পর মিষ্টি বিতরণ, শোনা যায় আমার নানা আশে পাশের ৪০ ঘর পর্যন্ত মিষ্টি বিলিয়েছিলেন,কারণ ইসলামে বলা আছে ৪০ ঘর পর্যন্ত সবাই প্রতিবেশী। কাহিনীর সত্যতা জানা জায়নি,কারণ অনেক ঘরই এখন আর নেই,যাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি সবাই হেসে বলেছে “ তোমার জন্মের মিষ্টি খাইচি গেদু (বাচ্চা/বাবু)”

আমার বাবা তখনও আমার জন্মের কথা জানেন না,বেচারা অপেক্ষা করছেন আমার মায়ের ফেরার। তখন লঞ্চ এবং স্টিমার উভয় চলত,সেখানে সারেং এর মাধ্যমে মিষ্টি আর খবর পাঠানো হোল আমার জন্মের। পরের দিন সকালে ঢাকা থেকে এসে উপস্থিত হলেন আমার বড় ফুপি এবং ফুপা। তাঁরা অবশ্যই আমার জন্মের খবর জানতেন না,মাকে দেখতে এসেছন। বড় ফুপা নিয়ে এসেছেন এক কুড়ি ইলিশ মাছ আর এক কার্টুন কমলা। আমার রূপ চেহারা দেখে বড় ফুপি খুব মুগ্ধ হলেন,নিজের গলার চেইন খুলে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কোলে নিয়ে ফুপি আমাকে সারা বাড়ি হেটেছেন আর বলেছেন “ মনু তুই এত শাদা,তুই গিরিবাজ কইতরের লাহান শাদা”

আমাকে মা যখন এই কথা বলেন আমাকে বলেন,আমি প্রশ্ন করি “ শাদার মাহাত্ত বুঝলাম না আম্মু”
মা বলেন তিনি দেখতে শ্যামলা ছিলেন,এই জন্য সবার ধারনা ছিল বাচ্চাও কালো হবে,কিন্তু যেহেতু আমি ফর্শা হয়েছি এই জন্য সবাই মাত্রাতিরিক্ত খুশি হয়েছে। আর সেই সাথে প্রথম সন্তান ছেলে,এটা আলাদা একটা গর্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক পুরুষই এক একটা ট্রাম কার্ড। আমার হিসাবই বা তার বাইরে হবে কেন?

টুইস্টিং রোমান্স

এখন আবার একটু পেছনে ফিরে যাচ্ছি
একটা বড় খাওয়ার আয়োজন করা হোল নানাবাড়িতে, মূল উদ্দেশ্য ডাক্তারকে খাওয়ানো,এবং সেই সাথে নিজেরা ভালো মন্দ খাওয়া। গরু গরু রব উঠলেও শেষমেষ দফা রফা হয় খাশিতে। কারণ ডাক্তার হিমেল গো মাংস ভক্ষন করেন না।
খাশি জবাই করলেন মফাজ্জল নানা,চামড়া ছিলেছেন আমার নানা নিজে,বিকালের দিকে আসলেন ডাক্তার সাহেব। আমেনা খালা চলে এসেছিলেন সকাল সকাল, নানিকে পিঠা বানাতে সাহায্য করেছিলেন। মূল খাওয়া দাওয়া শুরু হয় সন্ধ্যার পর, বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল এই ভোজনপর্ব শেষ হতে। নানি টিফিন কেরিয়ারে করে মাংশ আর পিঠা দিয়ে দিলেন ডাক্তারকে। রাস্তায় অন্ধকার তখন,হ্যাজাক দিয়ে ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আসতে চাইলেন আমার নানা। কিন্তু
আমেনা খালা বললেন তার কাছে টর্চ আছে, ডাক্তার সাহেবকে তিনি বড় রাস্তায় ছেড়ে,সেখান থেকে বাসায় ফিরবেন। খুবই উত্তম প্রস্তাব।
ছোট্ট ঘটনাটার সূচনা এখানে,সেই রাতে আর বাসায় ফিরে যাননি ডাক্তার সাহেব। বড় রাস্তায় বা বাজারেও তাকে কেউ দেখনি সেই রাতে,বরঞ্চ দেখেছে পরদিন কাক ডাকা ভোরে।

এর পরে তাদের দীর্ঘদিনের প্রেম চলেছে,ডাক্তারের স্ত্রী থাকতেন তার গ্রামের বাড়িতে। আমি আমার মা না থাকলেও তখন তুষখালিতে ডাক্তারের আসা পড়ত সপ্তাহে কমপক্ষে দু বার। সেইদিন গুলোতে আমেনা খালা ভালো মন্দ রান্না করেন,রসের পিঠা বানান।
সেই পর্যন্ত সেই ভালোবাসা তিক্ততায় পরিনত হয়, আমেনা খালা ডাক্তারের সাথে ঘর বাধতে চান, ডাক্তার বার বার বুঝিয়ে বলতে থাকেন আমেনা খালাকে,শেষ পর্যন্ত আমেনা খালা এলাকার কয়েকজন শাণ্ডা পান্ডা দিয়ে ডাক্তারকে চাপ প্রয়োগ করেন।

ডাক্তার তুষখালিতে ৩ কানি ধানী জমি কিনেছিলেন,তিনি আমেনা খালাকে সেই জমি লিখে দিয়ে মঠবাড়িয়া ত্যাগ করেন। আর কোনদিন তিনি ফেরেননি পিরোজপুর জেলার আশে পাশে।

ভিজিটিং আমেনা খালা

গত জুলাই মাসের শেষের দিকে এক প্যাকেট মিষ্টি আর একটা শাড়ি নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমেনা খালার সাথে। খালা এর আগে সব সময় নিজেই আমাকে দেখতে আসতেন,যতবার মামা বাড়ি গিয়েছি ঠিক ততবারই।
আমেনা খালা আমাকে দেখে খুবই খুশি হন,সেই সাথে বিদেশে থাকি জেনে তার হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমারে লেবুর শরবত আর আম কেটে দিলেন খেতে, তার কাছ থেকেই উপরোক্ত অনেক ঘটনা শোনা।

তিনি খুব রসিক কথাবার্তা বলেন। এই যেমন আমি নাকি ছোট বেলায় তার তোষকের নীচ থেকে কনডমের প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম,তারপর কনডম এর মধ্যে বাতাস ফুলিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে সেই বেলুন নিয়ে খেলা করেছি। শুনে আমার কান লাল হয়ে গিয়েছিল,আর খালা তখন খিক খিক করে হাসছেন। আমি সাহস করে ডাক্তারের কথা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,তিনি হেসে বললেন “ জাইন্না তুমি কি করবা গেদু?” আমি বললাম এমনিতেই জানতে চাচ্ছি।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
“ প্রেমের ফাদ পাতা এ ভুবনে
কে কোথায় কখন ধরা পরে কে জানে!!”
খালার জন্য যে আমার সহানুভূতি উপচে পড়েছিল এটা বলব না,কিন্তু খারাপ লেগেছিল,কারণ তিনি সব জেনেই ডাক্তারমুখো হয়েছিলেন।

খালা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন, আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করি,কিছু উত্তর হয়ত জানি কিছু হয়ত জানি না। খালা বলেন “ তোমার চোখে তো রঙ লাগছে গেদু,শাদা সোনার রঙ”
আমি বুঝতে না পেরে মানে জিজ্ঞাসা করি । খালার সরাসরি উত্তর “ বিদেশী মাইয়াগো শাদা বুনি খাইছ গেদু,এখন কি আর দেশী বুনি স্বাদ লাগবো?”

উত্তর না দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভেবে আমি চুপচাপ বসে থাকি। খালা আরও বলেন ইসলামের ইতিহাসের কথা,যখন মুসলমানেরা দুনিয়া শাসন করেছেন তখনকার সময়ের শান্তির কথা। আমি হাই তুলে খালার কথা শুনি। বিদেশী মেয়েরা নাকি কুকুরের মতো পুরুষ বদলায় এমন প্রশ্নে আমি খালাকে কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারি না। আমি বোঝাতে পারি না যে সেখানের সমাজ ব্যবস্থা আর আমাদের সমাজ সম্পূর্ণ আলাদা,আমি বোঝাতে পারিনা,সেখানে মেয়েদের গায়ে হাত তুললে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়,সেখানে মেয়েরা পুরুষের মতো কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে,আয় করে,সন্তান পালে। আমি বোঝাতে পারিনা সেখানের মেয়েদের ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে।
খালা আমাকে ধীরে ধীরে কাবু করে ফেলতে থাকেন,খালা বলেন যারা রাস্তায় চুমু খায়,পুরুষের হাত ধরে রাস্তায় হাতে,ছোট কাপড় পড়ে তাদের আবার কিসের সমাজ? কিসের ধর্ম?

আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি, পরাজিত আমি। কুশিক্ষার কাছে যুক্তির মূল্য যেখানে শূন্য।

মফাজ্জল নানা বচন

এরপর আমি শাদা লুঙ্গি আর মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে যাই মফাজ্জল নানার সাথে। তিনি সদ্য শ্বশুর হয়েছেন,তাই শাদা লুঙ্গি। এই বুদ্ধি দিয়েছেন আমার ছোট মামা,তিনি আবার খুব সংসারি মামা, মালয়শিয়া ছিলেন দীর্ঘদিন,ফিরে এসে ঘোষণা করেছেন “ নানা,তাকে স্বপ্নে বলেছেন তালুকদার বাড়ির মেয়ে সীমাকে বিয়ে করতে” স্বপ্ন আর নানার কথা শুনে সবাই চট জলদি মামার বিয়ে ঠিক করে সীমা মামির সাথে। তখন কারো মনে ছিলনা যে এই সীমা মামিকেই মামা স্কুল জীবনের শেষ ভাগে আর কলেজ জীবনের প্রথমভাগে অনেক চিঠি লিখেছিলেন। বানান ভুলের কারনে মামি অধিকাংশ চিঠি আবার ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এবং মামি এখনও সেটা গর্ব করেই বলেন। অবশ্য মামি ইন্টার পরীক্ষায় পাশ না করতে পারার পর মামাও তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তিরস্কারের দাত ভাঙা জবাব দেন।

যাই হোক মজাজ্জল নানা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেন,বলেন আমার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে,ছোট বেলায় আমি একদম পোটকা মাছের মতো মোটাসোটা ছিলাম। সেখানে মফাজ্জল নানার বউ নিয়ে আসলেন ডাবের পানি আর চিড়ার মোয়া। ডাক্তারি পড়ছি শুনে মফাজ্জল নানা হুংকার দিলেন “ বউ,আমার ডাক্তারের কাগজটা নিয়ে আসো দেখি”
মিনিট খানেক পর কাগজ নিয়ে আসলেন মফাজ্জল নানার পুত্রবধু,আমার মতো ধামড়া একটা ছেলে হাফ প্যান্ট পড়ে লোমশ পা বের করে বসে আছে এটা দেখেই মাথার ঘোমটা লম্বা করলেন পুত্রবধু,আমার হাতে কাগজ দেবার সময় চোখাচুখি হোল তার,আমি বুঝলাম বউ ট্যাঁরা।

আমি নানাকে বললাম ডাক্তারের দেয়া ওষুধ নিয়মিত খেতে। কারণ আমি এখনও পেস্ক্রিপশন বোঝার মতো পড়াশুনা শেষ করিনি। এর পর তার জীবন কেমন চলছে জানতে চাইলাম। নানা একসময় মসজিদের ইমাম হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন তিনি রাজত্ব করেছেন এলাকার মসজিদে। কিন্তু বিপত্তি বাধায় এলাকার এক হজ করে ফেরা আলেম, এক শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর তিনি সবার সামনে প্রশ্ন করেন “ সূর্যগ্রহন ও চন্দ্রগ্রহনকালীন নামাজের নাম কি ইমাম সাহেব?”
মফাজ্জল চাচা দীর্ঘ নীরবতার পরে বলেন তিনি এই প্রশ্নের উত্তর জানেন না। এর পরে থেকেই মুলত নতুন ইমামের আগমন,নতুন ইমামকেও একই প্রশ্ন করেন হজ ফেরত আলেম।
নতুন ইমাম মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় “ সূর্যগ্রহনকালীন নামাজের নাম “সালাতিল ক্যুসুফি” এবং চন্দ্রগ্রহণকালীন নামজের নাম “সালাতিল খুসুফি”

হজ ফেরত আলেম সম্মতি জানান,এর পর এলাকা জুড়ে হজ ফেরত আলেম এবং নতুন ইমামের দ্বীনের সুনাম ছড়িয়ে পরে। যদিও মফাজ্জল নানা মনে করেন এই উত্তর আলেম আগেই ইমামকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া এই তথাকথিত আলেম হজে যাবার আগে অনেক খারাপ মানুষ ছিলেন। আমি জানতে চাইলাম কেমন খারাপ মানুষ?
মফাজ্জল নানা উত্তর দিলেন,এই আলেম মদখোর ছিলেন,আর পোলাখোর। ওনার কাঠ বিক্রির ব্যবসা,কাঠের গুদামের পাশে অফিস,সন্ধ্যার পর তিনি অফিসের দোতালায় বসে আকণ্ঠ মদ খান এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে বাচ্চা ছেলে ভাড়া করে এনে নাচান। পোলাখোর শব্দটার মানে বুঝতে না পেরে আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম।
মফাজ্জল নানা বললেন ” হালার পুতে পোলা খেলায়,পোলা ধইরা আইনা হোগায় দেয়।” মফাজ্জল নানার কথা থেকে আমি বুঝতে পারলাম হজ ফেরত আলেম সাহেব শিশুকামী এবং বিকৃত রুচির।

মফাজ্জল নানা আরও বলেন হজ করলেই আলেম হওয়া যায় না। এই এলাকায় মফাজ্জল নানার বাবা ছিলেন প্রকৃত আলেম,তিনি ছিলেন বোম্বাই হাজি। তখনকার সময়ে যারা হজে যাবার মনস্থির করে ঘর ছাড়তেন কিন্তু বিভিন্ন কারণ বশত বোম্বে শহর থেকে ফিরে আসতেন তাদের বলা হয় বোম্বাই হাজি। তখনকার সমাজে বোম্বাই হাজিদের খুব কদর এবং খাতির করা হত।

মফাজ্জল নানা এখন আছেন ভালই,শহরের উপরে একটা পাকা মার্কেট করেছেন,দোতালায় আওয়ামীলীগের অফিস,নীচে ভাতের হোটেল আর সিডি ভিসিডির দোকান। ভাড়া দিয়ে বেশ চলে যায় তার। তবে ইদানীং একটু টেনশনে আছেন,তার ছেলের দুবাই যাবার বিষয়ে এক দালালকে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন, দালাল আজ বলে এই ঈদে পাঠবো,কাল বলে কোরবানির ঈদের পর।

ছেলের বউ খুব ধার্মিক, গুদিকাঠা নামক এক জায়গার এক নামী পীরের মুরিদ। তবে মফাজ্জল নানার বউয়ের সন্দেহ তার পুত্রবধু বাঁজা মেয়েমানুষ। প্রায় ৮-৯ মাস হয়েছে বিয়ের এখনও কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।
আমি বললাম,হয়ত তাঁরা ইচ্ছে করেই বাচ্চা নিচ্ছে না,মাত্রই তো বিয়ে হোল। আমাকে বলা হোল নানার ছেলে নিতে চাচ্ছে বাচ্চা,কিন্তু হচ্ছে না। অতএব বউ বন্ধ্যা।
আমি বললাম নানি,হয়ত মামার( নানার ছেলে) সমস্যা থাকতে পারে,ডাক্তার দেখালে এবং টেস্ট করলে বোঝা যাবে,কোনটা সঠিক। স্বামী স্ত্রী আমাকে নিয়ে খুব একচোট হেসে নিলেন। আমি হাসি শেষ হবার অপেক্ষায় থাকলাম। হাসি শেষে নানি বললেন
“মুরোদের পো মুরোদ হয় বুঝালা গেদু, আর বউয়ের বড় বোনের বাচ্চা হয়না,ধুমসি বুড়ি হয়ে গেছে,দুই বুইনের একই সমস্যা মনে হইতাছে”
আমি নতুন অনেক কিছু জেনে,শিখে চলে আসলাম।

শেষাংশ

এই মানুষগুলোর হাতেই আমার জন্ম হয়েছিল,আজ একটু স্মৃতিচারণ করলাম তাদের নিয়ে, আমার জন্ম তাদের কাছে হয়ত আরও ১০ টা সাধারন শিশুর মতই সাধারন, কিন্তু আমার কাছে এই মানুষগুলো অসাধারণ। তাদের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে,জানতে ভালো লাগে তাঁরা কেমন আছে,কিভাবে বেঁচে আছে।
আবার আমি দেশে গিয়ে এদের সাথে দেখা করবো, আবার আমার জন্মের গল্প শুনবো। আমার সামনের বছরের জন্মদিনে আবার হয়ত এই লেখাটা বের করে পড়ব,তখন আবার আমার রক্তে রক্তে বইবে আমার জন্মস্থান,এই প্রিয় মানুষগুলি।

২৫ শে মে,২০১২
সেন্ট পিটার্সবার্গ ( লেলিনগ্রাদ)
রাশিয়া।